।।বিকে রিপোর্ট।।
সাগরে মৎস্য আহরণে ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে বুধবার রাত ১২টায়।
বৃহস্পতিবার ১২ জুন রাতের প্রথম প্রহরেই গভীর সাগরে যাত্রার প্রস্তুতি শেষ করছেন সাগরপাড়ের জেলেরা। কেউ ট্রলার মেরামত করছেন, কেউ জাল সেলাই করছেন, কেউ আবার প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীসহ অন্যান্য সরঞ্জাম প্রস্তুত করছেন।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মাছের সুষ্ঠু প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য ২০১৫ সাল থেকে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় বিভিন্ন মেয়াদে মৎস আহরণে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে সরকার। এতে করে দেশে মৎস সম্পদে যেমন সমৃদ্ধ হচ্ছে তেমনি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আসছে। ২০২৩ সালের ২০ পর্যন্ত সমুদ্র সীমায় ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছিল সরকার।
পরে দেশের মৎস্য গবেষক, জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা ভারতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা পুনর্বিন্যাসের দাবি করলে চলতি বছর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে ৫৮ দিনে নিয়ে আসে। এই দফায় ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন রাত ১২টা পর্যন্ত সমুদ্রে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা ছিল।
এই নিষেধাজ্ঞায় অনেক জেলে পরিবারে নেমে আসে সংকট। অনেকে ধারদেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। তার পরও আশাবাদী জেলেরা—এবার সাগরে নামলেই মিলবে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ।
বরগুনা সদর উপজেলার বাইনচটকী এলাকার জেলে হোসেন আলী বলেন, দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে পাথরঘাটায় চলে এসেছি। এখন পুরোনো জাল সেলাই করছি। এক সপ্তাহের বাজারও করে এনেছি। আজ বিকেলে সাগর মোহনায় যাব, গভীর রাত থেকে জাল ফেলব।
আলাউদ্দিন বলেন, এইবার আশা করছি খালি হাতে ফিরমু না। ঝড়-বন্যার আভাস নাই। মোটামুটি সাতদিন সাগরে থাকার বাজার করেছি। মাছ ধরা পড়লে ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারবো।
আলাউদ্দিনের সংসার প্রায় দুইমাস অনেকটা অভাব অনটনে কেটেছে। কষ্ট করে সংসার চালালেও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সাগরে যাননি।
দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্রগামী লক্ষাধিক জেলের মনেও আলাউদ্দিন মিস্ত্রির মত আনন্দ। সাগরে মাছ ধরার ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে ১১ জুন মধ্যরাতে। ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের জেলেরা ট্রলার নিয়ে সাগর অভিমুখে যাত্রা করেছে।
মৎস অধিদপ্তর বলছে, উপযুক্ত সময়ে প্রজনন হওয়ায় এবার কাঙ্ক্ষিত মাছ জেলেরা পাবেন। এতে করে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের দাম কমে আসবে।
এদিকে সাগরে নিষেধাজ্ঞা চলাকালেও কিছু অসাধু জেলে মাছ শিকার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে পাথরঘাটা মৎস্যঘাটে গত কিছুদিন ধরে মাছের সরবরাহ ছিল। ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের নজরদারি কমে যাওয়ায় ৩ জুন থেকে কিছু ট্রলার সাগরে যাওয়া শুরু করে। এদের মধ্যে জেলে হাবিবুর রহমান সোমবার মাছ নিয়ে ঘাটে ফেরেন।
তিনি বলেন, মোট ৬ লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছি। কিন্তু বরফ ও অন্যান্য খরচ মিটিয়ে প্রায় দেড় লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। বরফকলের মালিকেরা ক্যানপ্রতি বরফের দাম ১৩০ টাকার জায়গায় ২০০ টাকা নিচ্ছেন। আর প্রশাসনের একটি চক্র ট্রলারপ্রতি ১৫-২০ হাজার টাকা চাঁদা নিয়েছে।
তবে পাথরঘাটা বরফকল মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ মেহের কান্তি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, লোডশেডিংসহ বিভিন্ন কারণে বরফ উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। সে কারণে দাম কিছুটা বাড়ানো হয়েছে।
জেলে ইউসুফ মাঝির অভিযোগ, নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের নামে আসলে লোক দেখানো অভিযান হয়েছে। প্রশাসনের একাংশ ‘ম্যানেজ’ করে বহু ট্রলার সাগরে গিয়ে মাছ ধরেছে।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. মহসীন বলেন, আমি ঈদের ছুটিতেও পাথরঘাটায় অবস্থান করে কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছি। তার পরও বিশাল সাগর এলাকায় কিছু অসাধু জেলে সুযোগ নিয়েছেন। আমরা বরফের অতিরিক্ত উৎপাদন করায় কয়েকজন বরফকল মালিককে জরিমানাও করেছি।
বরিশাল বিভাগীয় মৎস অফিস জানিয়েছে, বিভাগের ছয় জেলায় নিবন্ধিত ৪ লাখ ২১ হাজার ৯৩ জন জেলের মধ্যে এক লাখ ৪৬ হাজার ২৯ জন সমুদ্রগামী জেলে। এসব জেলেরা সাধারণত সাত হাজার ৪০৫টি মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে যান।
মঠবাড়িয়া উপজেলার খেতাছিড়া গ্রামের জেলে আজহারুল ইসলাম বলেন, এক ট্রিপ মাছ ধরতে সাগরে যেতে ৪/৫ লাখ টাকার খরচ হয়। বাজারে সবকিছুর দাম বেশি থাকায় খরচ বেড়েছে। আমরা নিবন্ধিত জেলে হয়েও কোনও আমলে সরকারি সব সহায়তা পাই না। এবার এক ট্রিপ চাল পেয়েছি। বাকি চাল আর পাবো কিনা জানি না।
এ বিষয়ে বরিশাল বিভাগীয় মৎস অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আলফাজ উদ্দিন শেখ বলেন, ৫৮ দিনের নিষিদ্ধকালীন সময়ের মধ্যে ৪২ দিনের সরকারি সহায়তার বরাদ্দ বিতরণ করা হয়েছে। বাকি সহায়তা আরেক ধাপে দেওয়া হবে। আমরা বরাদ্দের সকল চাল এখনো পাইনি। আসামাত্র জেলেরা পেয়ে যাবেন।
তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞে উঠে যাওয়ায় বাজারে মাছের আমদানি বাড়বে বলে আশা করছি। এতে করে ইলিশসহ সকল মাছের দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসবে।