চলমান গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় দ্বিতীয় দফায় বন্দি বিনিময়ের অংশ হিসেবে শনিবার দুপুরের দিকে জিম্মি চার ইসরাইলি নারী সেনাকে মুক্তি দেয়া হয়।
গত শুক্রবার ২৪ জানুয়ারি তাদের নাম ঘোষণা করে হামাস। মুক্তিপ্রাপ্তরা হলেন যথাক্রমে করিনা আরিভ, ড্যানিয়েলা গিলবোয়া, নামা লেভি ও লিরি আলবাগ।
আল জাজিরা জানায়, আন্তর্জাতিক সংস্থা রেড ক্রসের মাধ্যমে চার নারী জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। মুক্তিপ্রাপ্তদের তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)।মুক্তিপ্রাপ্ত চার নারী সেনা সুস্থ রয়েছে। মুক্তির সময় তাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে ব্যাগ ছিল। তাদেরকে হাসিমুখে জনতার দিকে হাত নাড়তে দেখা যায় এবং তারা বিজয়সূচক চিহ্নও দেখিয়ে ছবিও তোলেন।
শনিবার ২৫ জানুয়ারী চার নারী সেনাকে হাতে পাওয়ার পর বিকেলের দিকে রামাল্লার কাছে ওফার কারাগার থেকে ২০০ ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছেড়ে দেয় ইসরাইল। এরপর মুক্তিপ্রাপ্ত ফিলিস্তিনি বন্দিদের তিনটি বাসে করে অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লার পশ্চিমে অবস্থিত বেইতুনিয়া শহরে নেয়া হয়।
বেইতুনিয়ায় তাদেরকে স্বাগত জানায় হাজার হাজার সাধারণ মানুষ যেখানে তারা আগে থেকেই জড়ো হয়েছিলেন। এ সময় ধূসর জাম্পস্যুট পরা বন্দিদের বাস থেকে নেমে আসতে দেখা যায়। এ সময় তারা উপস্থিত জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার পর এ নিয়ে দ্বিতীয় দফায় চার জিম্মিকে মুক্তি দিলো হামাস। ২০২৩ সালের সাতই অক্টোবর হামাস ইসরাইলের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে হামলা করার পর যাদের জিম্মি করে নিয়ে এসেছিলো তাদের মধ্যে এই চারজনও ছিলো।
মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বেশ কয়েক হাই-প্রোফাইল ব্যক্তি রয়েছেন। তারা সবাই হয় যাবজ্জীবন অথবা দীর্ঘমেয়াদী সাজা ভোগ করেছেন। মোহাম্মদ আল-তুস নামে একজন বন্দি প্রায় চার দশক ধরে ইসরাইলি কারাগারে বন্দি ছিলেন। তাকে ১৯৮৫ সালে গ্রেফতার করা হয়।
আল-তুস ফাতাহ‘র সদস্য ছিলেন, যা এখন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অংশ। তিনি সেই সময় ইসরাইলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন এবং জর্ডান সীমান্তে একটি বড় বন্দুকযুদ্ধের সময় তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।
যে ৭০ জন ব্যক্তিকে মিশরে পাঠানো হবে তাদের একজন এই আল-তুস। রামাল্লাহর কাছে আমারি বন্দিশিবিরে একটি ফিলিস্তিনি পরিবার বন্দি রয়েছে। যাদের পাঁচজনই সহোদর ভাই। তাদের মধ্যে তিনজনকে আজ মুক্তি দেয়া হয়েছে। তবে তাদের সবাইকে মিশরে নির্বাসিত করা হবে। আরেকজন কারাগারে ক্যান্সারে মারা গেছেন।
শনিবার এক বিবৃতিতে আইডিএফ জানায়, ফেরত আসা চার জিম্মি বর্তমানে আইডিএফের বিশেষ বাহিনীর সঙ্গে ইসরাইলে ফিরছেন। সেখানে প্রথমে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে বলে জানায় বিবিসি।
এদিকে জিম্মি ওই চারজন এবং তাদের পরিবারের গোপনীয়তাকে সম্মান জানাতে সবার প্রতি অনুরোধ করেছে আইডিএফের এক মুখপাত্র। সেখানে ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনীর কমান্ডার এবং সৈন্যরা ফেরত আসা জিম্মিদের স্বাগত জানায়। তারা এখন ইসরাইলে তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছেন।
ইসরাইলের সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম কান জানিয়েছে, তাদের ইসরাইলি আইডিএফের একটি বিশেষ সামরিক ইউনিটের যোদ্ধাদের সঙ্গে রেইমের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হবে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজার কাছে নাহাল ওজ সামরিক ঘাঁটি থেকে ইসরাইলের একটি সামরিক নজরদারি ইউনিটের এই চার নারী সদস্যকে আটক করে নিয়ে যায় হামাস। ইসরাইল সরকারের তথ্য মতে, অতর্কিত হামলায় ওইদিন প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে বন্দি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও কাতারের কয়েক মাসের মধ্যস্থতায় টানা ১৫ মাসের সংঘাতের পর গত সপ্তাহে গাজায় দ্বিতীয়বারের মতো যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে একমত হয় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। পাঁচদিন পর স্থানীয় সময় রোববার বেলা সোয়া ১১টায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, প্রথম দফায় ওইদিন তিন ইসরাইলি বন্দিকে মুক্তি দেয় হামাস। বিপরীতে ৯০ ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি দেয় ইসরাইল।
কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ওই বছরের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে প্রথম যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়।
সাতদিনের যুদ্ধবিরতিকালে ১১০ জন বন্দিকে মুক্তি দেয় হামাস। বিপরীতে ইসরাইল ২৪০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেয়, যাদের সবাই নারী ও শিশু।
প্রায় ১৫ মাস পর গত সপ্তাহে দ্বিতীয় যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তি অনুযায়ী ছয় সপ্তাহের মধ্যে হামাসের হাতে থাকা ৩৩ ইসরাইলি জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে ইসরাইল তাদের হাতে আটক কয়েকশ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেবে। সেই হিসাবে হামাস আগামী পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে আরও ২৬ জন বন্দি মুক্তি দেয়ার কথা।
যুদ্ধিবিরতি চুক্তি শর্ত অনুসারে ইসরাইলি বাহিনীর এখন গাজার নেটজারিম করিডোর থেকে সরে যাওয়ার কথা। এবং এরপর উদ্বাস্তু গাজাবাসী তাদের ঘরে ফিরবেন। কিন্তু বন্দি বিনিময় সম্পন্ন হওয়ার পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু করিডোর খোলার চুক্তি না মানার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এরপর ইসরাইলি সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল হার্জি হালেভি উদ্বাস্তু গাজাবাসীকে নেটজারিম করিডোরে এখনই না ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনী নেটজারিম করিডোরের মূল্যায়ন সম্পন্ন করেছে এবং ‘অন্য কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়া পর্যন্ত’ ওই এলাকায় বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে।