।।বিকে আন্তর্জাতিক ডেস্ক।।
গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে কাতারে পরোক্ষ আলোচনা ইসরাইলের সেনা প্রত্যাহারে অনীহার কারণে আটকে গেছে বলে শনিবার ফিলিস্তিনি দুইটি সূত্র এএফপিকে জানিয়েছে।
গত রবিবার কাতারে শুরু হওয়া এই আলোচনার লক্ষ্য ছিল অক্টোবর ২০২৩ সালের ৭ তারিখ হামাসের হামলার মাধ্যমে শুরু হওয়া ২১ মাসব্যাপী যুদ্ধের একটি সাময়িক বিরতি।
হামাস ও ইসরাইল উভয়েই জানিয়েছিল, যদি ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সমঝোতা হয়, তবে ১০ জন জীবিত জিম্মিকে মুক্তি দেওয়া হবে, যাদের ওই হামলার দিন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বৃহস্পতিবার বলেন, তিনি ‘কয়েক দিনের মধ্যেই’ একটি চুক্তি প্রত্যাশা করছেন, যা দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধের অবসানেও সহায়ক হতে পারে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফিলিস্তিনি সূত্র বলেন, হামাসের দাবিমতো গাজা থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহারে ইসরাইলের অনীহা অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অন্য এক সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ দোহায় পৌঁছানো পর্যন্ত মধ্যস্থতাকারীরা আলোচনা মুলতবি রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
দোহায় চলমান যুদ্ধবিরতি আলোচনা কার্যত ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ফিলিস্তিনের এক কর্মকর্তা।
শুক্রবার রাতে তিনি বিবিসিকে জানিয়েছেন, ইসরাইলি প্রতিনিধিদল আলোচনা বিলম্বিত করেছে। আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার নাম করে মূলত সময়ক্ষেপণ করছে তারা।
ফিলিস্তিনি ওই কর্মকর্তা বলেছেন, দোহায় হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে আট দফা আলোচনা হয়েছে। ইসরাইল দোহায় এমন একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে যাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ক্ষমতাই নেই। একই সঙ্গে নেতানিয়াহুর যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় প্রতিনিধিরা কৌশলে গতি মন্থর রাখছে।
মূল আলোচ্য বিষয় গাজা থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার এবং মানবিক সহায়তা বিতরণ, যেগুলোতে এখনো মতবিরোধ রয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেছেন নেতানিয়াহু।
এর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ৬০ দিনের একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির চুক্তি হবে এবং পরে স্থায়ী চুক্তির আলোচনা শুরু হবে। কিন্তু তিনি হুমকি দেন, হামাস যদি ইসরাইলের শর্তে রাজি না হয় তাহলে গাজায় আবারও হামলা শুরু হবে।
এই আলোচনার একটি বড় জটিলতা হলো গাজা থেকে ইসরাইলি সেনা কতদূর পর্যন্ত সরে যাবে। পঞ্চম দফা আলোচনায় ইসরাইল বলেছিল তারা সীমান্ত থেকে ১-১.৫ কিলোমিটারের মধ্যে থাকবে। কিন্তু পরবর্তীতে তারা যে মানচিত্র দিয়েছে তাতে দেখা গেছে, সেনারা গাজার তিন কিলোমিটার পর্যন্ত ভেতরে থাকবে।
এই ম্যাপ অনুযায়ী, রাফার পুরো অংশ, খান ইউনিসের পূর্বাঞ্চল (খুজা গ্রামের ৮৫ শতাংশ), বেঈত লাহিয়া ও বেঈত হানোনের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং গাজা সিটির তুফাহ, সেজাইয়া ও জেইতুন এলাকায় ইসরাইলি সেনাদের উপস্থিতি থাকবে।
হামাস এই মানচিত্র প্রত্যাখ্যান করেছে এবং একে বিশ্বাস ভঙ্গ হিসাবে দেখছে। ইসরাইল একটি ‘সেনা প্রত্যাহার মানচিত্র’ উপস্থাপন করলেও সেটি মূলত সেনা পুনঃবিন্যাস ও মোতায়েনের প্রস্তাব। এতে প্রকৃত অর্থে কোনো প্রত্যাহার নেই।
ফিলিস্তিনি সূত্র মতে, ইসরাইল গাজার ৪০ শতাংশেরও বেশি ভূখণ্ডে সেনা রাখার প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাস্তবে লাখো বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিকে রাফাহ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ করে রাখবে। তিনি বলেন, হামাস এই ছক গ্রহণ করবে না। এতে গাজার প্রায় অর্ধেক পুনর্দখলের বৈধতা দেওয়া হচ্ছে এবং গাজাকে বিচ্ছিন্ন ছিটমহলে পরিণত করা হচ্ছে।
এদিকে মানবিক সহায়তা বিতরণ নিয়েও রয়েছে তীব্র মতানৈক্য। হামাস চাচ্ছে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ হোক। অথচ ইসরাইল বিতর্কিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’র মাধ্যমে তা চালাতে চায়। যার ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে ইতোমধ্যে ৮০০ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন।
দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি সূত্র বলেন, ইসরাইলি প্রতিনিধি দল কোনো বাস্তব ক্ষমতা ছাড়াই এসেছে এবং কৌশলে আলোচনা বিলম্বিত করে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাচ্ছে।
ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, ইসরাইলি পক্ষ আলোচনায় আগ্রহী এমন চিত্র উপস্থাপন করলেও নেতানিয়াহুর আমেরিকা সফরকালে কোনো প্রকৃত অগ্রগতি হয়নি। এসব কারণে যুদ্ধবিরতি আলোচনার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়েছে এবং যে কোনো সময় তা ভেস্তে যেতে পারে।
৭ অক্টোবর ২০২৩-এ হামাসের হামলায় অন্তত ১,২১৯ ইসরাইলি নিহত হয়, এর জবাবে ইসরায়েলী হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৭,৮২৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নারী ও শিশু।
গাজার হামাস-নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, শনিবার জানায়, সর্বশেষ ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ১৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর আগের দিন শুক্রবার মারা যান আরও ৩০ জন, যাদের মধ্যে ১০ জন সহায়তার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী শনিবার জানিয়েছে, গত ৪৮ ঘণ্টায় তারা গাজাজুড়ে আনুমানিক ২৫০টি ‘সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তু’তে হামলা চালিয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে: অস্ত্রভাণ্ডার, টানেল, স্নাইপার পোস্ট, এবং ‘বিস্ফোরক জড়ানো স্থাপনা’।
তবে নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেন, ‘হামাসকে সামরিক হুমকি থেকে নিস্ক্রিয় করা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে কোনো শান্তি আলোচনা সম্ভব নয়। তিনি আরও জানান, হামাস যদি অস্ত্র ত্যাগ না করে, তবে ইসরাইল জোরপূর্বক তাদের নিরস্ত্র করবে।