।।বিকে আন্তর্জাতিক ডেস্ক।।
সম্প্রতি চীন সফরে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস প্রভাবশালী ভূরাজনৈতিক বার্তা দিয়েছেন।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্য নিয়ে গঠিত ‘সেভেন সিস্টার্স’ প্রসঙ্গে সরাসরি কথা বলে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ড. ইউনূসের এই বক্তব্য ভারতের জন্য একটি কৌশলগত বার্তা বহন করে।
চীনের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনায় ড. ইউনূস বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, স্থলবেষ্টিত সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলের জন্য সমুদ্রবন্দর না থাকায় বাংলাদেশ তাদের জন্য প্রধান প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করতে পারে। বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে তিনি চীনের উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করতে এই সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বৈঠকের আগে বিরল সম্মান প্রদর্শন করে নিজ অফিস কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে চীনা প্রেসিডেন্ট সি জিনপিং ড. ইউনূসকে স্বাগত জানান। আলোচনায় উঠে আসে তিস্তা নদী প্রকল্প, মংলা বন্দর উন্নয়ন, যুদ্ধবিমান ক্রয় ও বাংলাদেশে চীনের অর্থায়নে আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
চার দিনের চীন সফরে ড. ইউনূস একের পর এক কূটনৈতিক চমক দেখিয়েছেন। চীনা রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে, এবং এ যাত্রায় চীন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে। জটিল কূটনীতির চেয়ে উন্নয়নই তার প্রধান লক্ষ্য— এমন বার্তা দিয়ে চীনকে যেন জয় করেই দেশে ফিরছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা!
চীন সফরে সেভেন সিস্টার নিয়ে ধ্রুব সত্যটি প্রকাশ করেছেন ড. ইউনুস। কিন্তু তার বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ভারত। এমনকি, তার এই মন্তব্যকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্যে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন ভারতের গুটিকয়েক নেতা। ভৌগোলিক এই সত্যকে মেনে নিতে পারছেন না তারা। দুশ্চিন্তার পাশাপাশি ভারতীয় নেতাদের অনেকেই ক্ষেপেছেন এবং দুষছেন নিজের দেশের পররাষ্ট্রনীতিকেই। বলেছেন, এমন বক্তব্যকে ‘হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।
প্রধান উপদেষ্টার এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বিনা সিক্রি ড. ইউনুসের এই বক্তব্যকে ‘অত্যন্ত অদ্ভুত’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘তিনি (ড. ইউনূস) এমন মন্তব্য করার কোনো অধিকার রাখেন না। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভারতের ইতিবাচক আলোচনা ও চুক্তি রয়েছে।
ভারতীয় এই কূটনীতিক বলেন, আমি বাংলাদেশকে একটি বিষয় খুব স্পষ্টভাবে বলতে পারি, যদি তারা উত্তর-পূর্ব ভারতকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযোগের অধিকার দিতে আগ্রহী না হয়, তবে তারা জলপথের অধিকার হিসেবে কোনো অধিকার আশা করতে পারে না। তাই তাদের এটি খুব স্পষ্টভাবে জানা উচিত ও এ বিষয়ে তাদের কোনো ভুল ধারণা রাখা উচিত নয়। আমাদের এই বিবৃতির নিন্দা জানানো উচিত।
আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা ড. ইউনূসের মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মো. ইউনূস যে বক্তব্য দিয়েছেন, যা আপত্তিকর ও তীব্র নিন্দনীয়। এই মন্তব্য ভারতের কৌশলগত ‘চিকেনস নেক’ করিডোর নিয়ে অব্যাহত দুর্বলতাকে তুলে ধরে।
হিমন্ত শর্মা আরও বলেন মোহাম্মদ ইউনূসের এই ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়, কারণ এগুলো গভীর কৌশলগত জটিলতা ও দীর্ঘস্থায়ী এজেন্ডা তৈরি করতে পারে।
সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস কমিটির (এআইসিসি) মিডিয়া ও প্রচার বিভাগের চেয়ারম্যান ও কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সদস্য পবন খেরা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ভারতকে অবরোধের জন্য চীনকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের এই পদক্ষেপ আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য খুবই বিপজ্জনক। সরকার মণিপুরের দিকে নজর রাখছে না। চীন অরুণাচল প্রদেশে একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের পররাষ্ট্র নীতি এতটাই শোচনীয় অবস্থায় যে, আমরা যে দেশটির সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছি, সেই দেশটি এখন আমাদের ঘিরে ফেলার চেষ্টায় ব্যস্ত।
ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় আরেক রাজ্য ত্রিপুরার রাজনৈতিক তিপরা মোথা পার্টির নেতা প্রদ্দূত মানিক্যও ড. ইউনূসের মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন।
তিনি বলেছেন, এক সময় আমাদের যে আদিবাসীরা চট্টগ্রামকে শাসন করেছিল, তাদের সমর্থনে সমুদ্রে যাওয়ার জন্য ভারতের রুট তৈরি করার সময় এসেছে। আমরা আর অকৃতজ্ঞ শাসনব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল নই। ত্রিপুরার এই রাজনীতিক বলেন, ১৯৪৭ সালে পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজন ভারতীয় ইউনিয়নের অংশ হতে চাইলেও বন্দরটি ছেড়ে দেওয়াটা ছিল ভারতের সবচেয়ে বড় ভুল।
বাংলাদেশকে টুকরো টুকরো করে ফেলার মতো বেফাঁস কথা বলেছেন তিপরা মোথা পার্টির এই নেতা।
তিনি বলেন, উদ্ভাবনী এবং প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জের পেছনে বিলিয়ন বিলিয়ন অর্থ ব্যয়ের পরিবর্তে আমরা বাংলাদেশকে ভেঙেও ফেলে সমুদ্রের নিজেদের পথ তৈরি করতে পারি। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে সবসময় উপজাতিরা বসবাস করতেন; যারা ১৯৪৭ সাল থেকে ভারতের অংশ হতে চেয়েছিলেন। সেখানে ত্রিপুরা, গারো, খাসি এবং চাকমা জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষ রয়েছেন; যারা বাংলাদেশে তাদের ঐতিহ্যবাহী ভূমিতে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে বাস করেন। এটিকে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও তাদের কল্যাণের জন্য ব্যবহার করা উচিত।
প্রধানমন্ত্রী মোদির অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সঞ্জীব সান্যাল প্রশ্ন তোলেন, ড. ইউনূস কেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বলেন, আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভারতের সাতটি রাজ্য স্থলবেষ্টিত বলে ইউনূস চীনাদের কাছে প্রকাশ্যে আবেদন জানাচ্ছেন। চীনকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে স্বাগত জানানো হয়, কিন্তু এতে ভারতের সাতটি রাজ্য স্থলবেষ্টিত উল্লেখ করার তাৎপর্য ঠিক কী?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত-চীন ত্রিমুখী সম্পর্কের জটিলতাকে ফুটিয়ে তুলেছে। কিছু পর্যবেক্ষক মনে করেন, চীনের সাথে বাংলাদেশের বাড়তে থাকা সম্পর্ক ভারতের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা বাড়ায় ভারতের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে চীনের ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ কৌশলের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগকে ভারত তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে।
সূত্র: এনডিটিভি, আনন্দবাজার, এএনআই।