।।বিকে রিপোর্ট।।
দিনের মতো কলম বিরতি পালন করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদসহ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
তারা বাস্তবমুখী ও অংশীজনের মতামতভিত্তিক সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি, রাজস্ব সংস্কার সংক্রান্ত বিশেষ পরামর্শক কমিটির রিপোর্ট প্রকাশের দাবিও করেছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি করে জারি করা অধ্যাদেশ দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে বলে মতামত দিয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার ১৫ মে দ্বিতীয় দিনের মতো কলম বিরতি শেষে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তারা।
আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে দাবিগুলো তুলেছেন তার মধ্যে রয়েছে-প্রণীত রাজস্ব অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করা, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংস্কার সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা এবং পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিষয়ক শ্বেতপত্র আলোচনা-পর্যালোচনাপূর্বক প্রত্যাশী সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সব অংশীজনদের মতামত নিয়ে সমন্বিত, অংশগ্রহণমূলক ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার করা।
সংবাদ সম্মেলনে পরিষদের নেতারা বলেন, শতবর্ষ প্রাচীন এনবিআর বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের উদ্দেশ্যে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।
এ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে অত্যন্ত গোপনে, অতি দ্রুততার সঙ্গে এবং প্রত্যাশিত সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনকে অজ্ঞাত রেখে।
অথচ সরকার সামগ্রিক সংস্কার কার্যক্রম একটি কাঠামোবদ্ধ প্রক্রিয়ায় শুরু করেছিল। প্রথমে খাত ভিত্তিক কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়; কমিশনসমূহ তাদের প্রতিবেদন প্রদান করে। পরবর্তীতে এসব প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য একটি ‘ঐক্যমত কমিশন’ গঠিত হয়, যারা রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু রাজস্ব বোর্ড সংস্কারের ক্ষেত্রে সরকার একটি পৃথক পরামর্শক কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটির প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি, তাদের সুপারিশ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়নি। হঠাৎ করেই মধ্যরাতে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ মনে করে, দেশের মোট অভ্যন্তরীণ রাজস্বের প্রায় ৮৬ শতাংশই এনবিআরের মাধ্যমে আহরিত হয়, যা জাতীয় উন্নয়ন ব্যয়ের বড় অংশে সরাসরি অবদান রাখে। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৭৬ নম্বর আদেশ গঠিত ৫৩ বছরে এনবিআরে মোট ৩১ জন চেয়ারম্যান দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রায় সব চেয়ারম্যানই এসেছেন কাস্টমস ও কর ক্যাডারের বাইরে থেকে। প্রত্যেক চেয়ারম্যানের গড় মেয়াদ মাত্র ১.৭ বছর। চেয়ারম্যানদের স্বল্প মেয়াদ এবং আয়কর আইন, কাস্টমস আইন, ভ্যাট আইন ব্যবস্থাপনায় বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাব বোর্ডের অভ্যন্তরীণ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার কার্যকারিতাকে হ্রাস করেছে।
তারা বলছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সম্পর্কে একটি ধারণা হলো, এটি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। বাস্তবতা হলো, দুর্নীতি বাংলাদেশের একটি বিস্তৃত কাঠামোগত সমস্যা, যা শুধু এনবিআর নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি খাতেই কোনো না কোনোভাবে বিদ্যমান। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের খানা জরিপ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩ সালের খাতভিত্তিক দুর্নীতির তালিকায় কর ও কাস্টমসের অবস্থান ছিল ১৪তম, যেখানে ২০২১ সালে এ খাতটি শীর্ষ ১৫-এর বাইরে ছিল এবং ২০১৭ সালে ছিল ১৩তম অবস্থানে।
এই চিত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এনবিআরের দুর্নীতি প্রচলিত ধারণার বিপরীত।
অন্যদিকে, রাজস্ব নীতি আর বাস্তবায়ন পৃথক করতে হবে, এটি আইএমএফ এর শর্ত এবং এই শর্ত পূরণ না হলে বাংলাদেশ ঋণ পাবে না- এরকম একটি জোর প্রচারণা বাজারে চালু রয়েছে এ বিষয়ে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ বলছে, এনবিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইএমএফের অনেকগুলো সভা হয়েছে এই ঋণ আলোচনার শুরু থেকে। সেসব আলোচনায় অন্য অনেক শর্ত নিয়ে আইএমএফের শর্তের প্রসঙ্গ এলেও রাজস্ব নীতি পৃথক করতেই হবে- এরকম শর্তের কথা আসেনি।
তারা বলছেন, আমরা এনবিআর তথা রাজস্ব প্রশাসন সংস্কারের বিরোধী নই। আমরা চাই এই সংস্কার যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য হবে, দেশের স্বার্থ ও উন্নয়নধর্মী দর্শন এতে প্রতিফলিত হবে, রাজস্ব প্রশাসন অধিকতর কার্যকর, প্রগতিশীল ও দুর্নীতিমুক্ত হবে এবং সংস্কার কোনো গোষ্ঠীগত কায়েমি স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হবে না।
এদিকে জানা যায় গতকাল কলম বিরতির শেষ বিকেলে কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটে। এনবিআরের সামনে বহিরাগতদের নিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। দুপুরের দিকে প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন ব্যক্তি একটি ব্যানার নিয়ে পুলিশ পাহারায় সমাবেশ করে চলে যান। এনবিআরের চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমে কথা বলার কথা জানালেও অজ্ঞাত কারণে তা বাতিল করা হয়েছে।
এ সময় উপকর কমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান ও কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার সিফাত-ই-মরিয়মসহ কর্মকর্তারা বক্তব্য রাখেন।