।।বিকে আন্তর্জাতিক ডেস্ক।।
যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে গাজা উপত্যকার বিভিন্ন এলাকায় এখনও ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ বজায় আছে। এসব এলাকায় ১ হাজার ৫০০-এর বেশি ভবন ধ্বংস করেছে তারা। এবং গাজায় গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত তিনজন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে, অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনি গ্রামগুলোর ওপর হামলা বাড়িয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ২৪ ঘণ্টায় নিহতদের তথ্য নিশ্চিত করেছে। এদিকে, গাজার সিভিল ডিফেন্স সংস্থা টেলিগ্রামে দেওয়া এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা ৩৫ জন অজ্ঞাত ফিলিস্তিনির মরদেহ আল-শিফা হাসপাতালে স্থানান্তর করেছে, যেখানে তাদের পরিচয় শনাক্তের কাজ চলছে।
ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধে মৃতের সংখ্যা আনুষ্ঠানিকভাবে ৬৯ হাজার ছাড়িয়েছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৯ হাজার ১৮২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৯৪ জন আহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও ইসরায়েলি বাহিনী অন্তত ২৪৫ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস-নেতৃত্বাধীন হামলায় ইসরায়েলে মোট ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন এবং প্রায় ২০০ জনকে বন্দী করা হয়।
ধারণা করা হচ্ছে, দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধের পর গাজার বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো হাজারো নিখোঁজ মানুষের মরদেহ চাপা পড়ে আছে।
আল জাজিরার সাংবাদিক তারেক আবু আজযুম মধ্য গাজা থেকে জানিয়েছেন, নিজেদের প্রিয়জনদের সন্ধানে গাজার মানুষ এখনো নাসের হাসপাতাল, মর্গ ও মরদেহ শনাক্তকরণ কক্ষগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তারা দেহাবশেষ, ব্যক্তিগত সামগ্রী, দাগ, পোশাকের টুকরো বা আঘাতের চিহ্ন দেখে প্রিয়জনদের চেনার চেষ্টা করছেন।
অণ্যদিকে বিবিসি জানায়, ৮ নভেম্বর তোলা সর্বশেষ স্যাটেলাইট ছবিগুলোতে দেখা গেছে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)-এর নিয়ন্ত্রণে থাকা সম্পূর্ণ কয়েকটি পাড়া-মহল্লা এক মাসেরও কম সময়ে পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যা মূলত পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ বা বিস্ফোরণের মাধ্যমে ঘটানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে বিবিসি সতর্ক করে জানিয়েছে, কিছু এলাকায় স্যাটেলাইট চিত্র পাওয়া না যাওয়ায় আসল ধ্বংস হওয়া ভবনের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।
কিছু আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের মতে, এই ধ্বংসযজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্র, মিসর, কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করতে পারে।
তবে আইডিএফ-এর এক মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, তাদের কার্যক্রম যুদ্ধবিরতির কাঠামোর মধ্যেই পরিচালিত হচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা শান্তি পরিকল্পনার ২০ দফার প্রস্তাব, যার ওপর ভিত্তি করেই যুদ্ধবিরতি হয়েছে, তাতে বলা হয়েছিল-সমস্ত সামরিক অভিযান, যার মধ্যে আকাশ ও কামান হামলাও অন্তর্ভুক্ত, স্থগিত থাকবে।
বিবিসি ভেরিফাইয়ের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতির পরও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হাতে গাজার ভবন ধ্বংস অব্যাহত রয়েছে। িতারা একটি চেঞ্জ ডিটেকশন অ্যালগরিদম ব্যবহার করে যুদ্ধবিরতির আগে ও পরে তোলা রাডার চিত্র বিশ্লেষণ করেছে, যেখানে দৃশ্যমানভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনগুলো গণনা করা হয়।
এই বিশ্লেষণ মূলত ‘ইয়েলো লাইন’-এর পেছনের এলাকাগুলোর ওপর করা হয় — যা গাজার উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব প্রান্ত জুড়ে বিস্তৃত একটি সীমারেখা।
অক্টোবরের যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, ইসরায়েলি বাহিনী ওই রেখা পর্যন্ত পিছু হটার কথা ছিল, যা আইডিএফ প্রকাশিত মানচিত্রে হলুদ দাগে চিহ্নিত।
ধ্বংসপ্রাপ্ত অনেক ভবনই যুদ্ধবিরতির আগ পর্যন্ত অক্ষত অবস্থায় ছিল। যেমন: খান ইউনুসের পূর্বাঞ্চলীয় আবাসান আল-কাবিরা এলাকায়। স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যায়, ওইসব বাড়ি যুদ্ধবিরতির পর বিধ্বস্ত হয়েছে।
আবাসান আল-কাবিরার সাবেক বাসিন্দা লানা খালিল, যিনি এখন আল-মাওয়াসিতে বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছেন, বিবিসিকে বলেন, “আমাদের বাড়িটা ছিল এক টুকরো স্বর্গ — চারপাশে ছিল খামার আর সবজি ক্ষেত। এখন সব ধ্বংস।”
তিনি আরও বলেন, “ইসরায়েলি সেনারা কিছুই রেখে যায়নি। আমাদের ঘরবাড়ি সব উড়িয়ে দিয়েছে। আমরা আল-মাওয়াসির তাঁবু থেকেই ধ্বংসের শব্দ শুনেছি।”
রাফাহ শহরের পূর্বাঞ্চলীয় আল-বায়ুক এলাকায়ও একই ধ্বংসের চিত্র দেখা গেছে। যুদ্ধবিরতির আগে যেসব ভবন অক্ষত ছিল, সেগুলোও এখন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
নভেম্বরের শুরুতে প্রকাশিত একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় বিশাল বিস্ফোরণের পর ধুলোর মেঘে ঢেকে গেছে পুরো এলাকা। গাজা সিটি, শুজাইয়া এলাকা ও জাবালিয়া ক্যাম্পের ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালের কাছেও ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে।
ইসরায়েলের কৌশলগত বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা আইতান শামির বলেন, আইডিএফের এসব পদক্ষেপ যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ নয়। কারণ সেগুলো ‘ইয়েলো লাইন’-এর পেছনের এলাকায় হয়েছে, যা চুক্তির আওতার বাইরে বলে তিনি দাবি করেন।
সূত্র: বিবিসি