সাংবিধানিক পর্যালোচনা: বিচারকদের অবসর ও ৯৯ অনুচ্ছেদ
।।শহীদুল্লাহ ফরায়জী ।।
অবসরগ্রহণের পর প্রজাতন্ত্রের কর্মে সাবেক প্রধান বিচারপতির নতুন নিয়োগ নিয়ে আইনী এবং নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। এতে বিচার বিভাগের মর্যাদা ও গুরুত্বের বিষয়টিও সামনে এসেছে। এ বিষয়টি সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে সংযোজিত। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে সাংবিধানিক প্রশ্ন জড়িত- তাইএ বিষয়ে পর্যালোচনা প্রয়োজন।
১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে অবসরগ্রহণের পর বিচারকদের অক্ষমতা শিরোনামে ৯৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘কোন ব্যক্তি (এই সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের বিধানাবলী-অনুসারে অতিরিক্ত বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন ব্যতীত) বিচারক রূপে দায়িত্ব পালন করিয়া থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের বা অপসারিত হইবার পর তিনি কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি কিংবা কার্য করিবেন না এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’
অর্থাৎ ‘৭২ সালের সংবিধান- বিচারকদের অবসর গ্রহণের পর বা অপসারিত হওয়ার পর কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের অযোগ্য ঘোষণা করেছিলো। এর অন্তর্নিহিত কারণ ছিলো- বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের প্রভাব মুক্ত রাখা। অবসর গ্রহণের পর ভবিষ্যতে আবার নিয়োগে নির্বাহী বিভাগকে তুষ্ট করার প্রতি পক্ষপাত বা দুর্বলতা যেনো বিচার বিভাগের ভাব-মূর্তি ক্ষুন্ন না করে এবং বিচার কার্যক্রমে নির্বাহী বিভাগের রাজনৈতিক অভিপ্রায়কে প্রাধান্য না দেয়, সে লক্ষ্যে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছিলো।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ‘৭২ সালের সংবিধান চারবার সংশোধন করলেও সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদ স্পর্শ করেনি। এমনকি ১৯৭৫ সনের চতুর্থ সংশোধনীতে বিচার বিভাগের প্রথম পরিচ্ছেদের ৯৫, ৯৬, ৯৮ অনুচ্ছেদ এবং ১০২ , ১০৯, ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করলেও ৯৯ অনুচ্ছেদে কোনো সংশোধনী আনয়ন করা হয়নি।
সাংবিধানিক পর্যালোচনার প্রয়োজনে প্রজাতন্ত্রের কর্ম, প্রধান বিচারপতি ও বিচারক নিয়ে সাংবিধানিক ব্যাখ্যা কী তা উল্লেখ করছি। যেমন:-
১) সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘প্রজাতন্ত্রের কর্ম’ অর্থ অসামরিক বা সামরিক ক্ষমতায় বাংলাদেশ সরকার সংক্রান্ত যে কোনো কর্ম, চাকুরী বা পদ এবং আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্ম বলিয়া ঘোষিত হইতে পারে।
২) প্রধান বিচারপতির ব্যাখায় ‘প্রধান বিচারপতি’ অর্থ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি।
৩) বিচারকের ব্যাখায় বলা হয়েছে ‘বিচারক’ অর্থ সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিভাগের কোনো বিচারক।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চমদশ সংশোধনীতে ৯৯ অনুচ্ছেদের সংশোধন আনয়ন করে। কী প্রয়োজনে বা উদ্দেশ্যে ‘৭২ সালের সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনা হলো তার কোনো ব্যাখ্যা জানা যায়নি।
এতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের শুধুমাত্র বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় পদ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে নিয়োগ লাভ বারিত করেছে এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে অবসর গ্রহণের পর, শুধুমাত্র আপিল বিভাগে ওকালতি বা কার্য করিতে পারিবেন ব’লে অনুমোদন দিয়েছে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধন আইন, ২০১১ সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদ প্রতিস্থাপন করে; বিচারকদের অবসরের অক্ষমতা শিরোনামে অনুচ্ছেদ ৯৯ (১) বলা
হয়েছে- ‘কোনো ব্যক্তি (এই সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের বিধানাবলী-অনুসারে অতিরিক্ত বিচারকরূপে দায়িত্ব পালন ব্যতীত) বিচারক রূপে দায়িত্ব পালন করিয়া থাকিলে উক্ত পদ হইতে অবসর গ্রহণের বা অপসারিত হইবার পর তিনি কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষের নিকট ওকালতি বা কার্য করিবেন না এবং বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় পদ ব্যতীত
প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের যোগ্য হইবেন না।’
৯৯ (২) ১ দফায় যা কিছুই থাকুক না কেনো, কোনো ব্যক্তি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক পদে বহাল থেকে উক্ত পদ হতে অবসর গ্রহণের পর তিনি আপিল বিভাগে ওকালতি বা কার্য করতে পারবেন।
মূল বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে- যিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন তিনি বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় পদে নিয়োগ লাভ করতে পারবেন।
কিন্তু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সাবেক দু’জন প্রধান বিচারপতিকে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ দিয়েছেন। এটাই সাংবিধানিক বিতর্কের উৎস।
উক্ত দু’জন সাবেক প্রধান বিচারপতি ‘বিচারক’ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেননি, তাঁরা প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। সুতরাং প্রধান বিচারপতির অবসরের পর কোনো কর্মে নিয়োগ করার প্রশ্নে সাংবিধানিক কোনো বিধান নেই। কারণ বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি উচ্চ মর্যাদার পদ। যিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত এবং রাষ্ট্রপতির নিকট শপথ গ্রহণকারী, তিনি প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে আর যোগদান করতে পারেন না।
কয়েকজন সাবেক প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি এবং তত্ত্বাবধায় সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়েছেন। যেহেতু রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বা সরকার প্রধান প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদ নয়, সেহেতু সাবেক প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি বা তত্ত্বাবধায় সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে পেরেছেন।
প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন হচ্ছে সংবিধান। সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো আইন রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান প্রণয়ন বা প্রয়োগ করতে পারে না। প্রণয়ন করলেও তা বাতিল হবে।
এবিএম খায়রুল হক এবং হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী- এই দু’জন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ ক’রে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। বিচার বিভাগীয় বা বিচার বিভাগীয় পদে কেবলমাত্র অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণ নিয়োগ লাভ করতে পারবেন, প্রধান বিচারপতি নয়। বাংলাদেশ আইন কমিশন এবং বিচার প্রশাসন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট- বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান নয়। অতএব সেখানে প্রধান বিচারপতি তো দূরের কথা, বিচারকগণও নিয়োগ লাভ করতে পারেন না।
আমরা আইন কমিশন ও বিচার প্রশাসন ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিবেচনা করতে পারি। আইন কমিশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে- যেহেতু দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রবর্তন ও বিভিন্ন আদালতে বহুসংখ্যক মামলা দীর্ঘদিন বিচারাধীন থাকার পরিপ্রেক্ষিতে এবং মৌলিক মানবাধিকার পরিস্থিতির আইনগত দিকসমূহ পুনরীক্ষণ ও আইন শিক্ষার মানোন্নয়ন-সহ অন্যান্য জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান করার লক্ষ্যে অচল আইনসমূহ বাতিল, প্রচলিত অন্যান্য আইনসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উহাদের যুগোপযোগী সংস্কার অথবা ক্ষেত্রমত নূতন আইন প্রণয়ন করার উদ্দেশ্যে সরকারের নিকট সুপারিশ পেশ করার জন্য একটি স্থায়ী আইন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা সমীচীন ও প্রয়োজন। আর বিচার প্রশাসন ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে- যেহেতু বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তি, আইনজীবী ও বিচার ব্যবস্থার সহিত সম্পৃক্ত কতিপয় অন্যান্য পেশাজীবীগণের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন; এবং যেহেতু উক্তরূপ প্রশিক্ষণের আয়োজন ও পরিচালনার জন্য বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নামে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপন করা সমীচীন ও প্রয়োজন;
সুতরাং উক্ত দু’টি প্রতিষ্ঠান বিচার বিভাগীয় বা আধা-বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান নয় বিধায় এই দুই প্রতিষ্ঠানে কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারককেই সংবিধানের নির্দেশনা মোতাবেক নিয়োগ দেওয়া যায় না। প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ দুই সাবেক প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক।
প্রধান বিচারপতি এবং বিচারক দু’টি সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির অবস্থান বা মর্যাদা কোনোক্রমেই বিচারকের সমকক্ষ নয়। ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ এবং ‘সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক’ বলতে একই বিষয় বোঝায় না। সংবিধান এই দু’টি পদের মাঝে পার্থক্য স্পষ্ট রাখার স্বার্থেই প্রতিবার ’প্রধান বিচারপতি’ এবং ’বিচারক’ পদ দু'টি আলাদা আলাদাভাবে উল্লেখ করেছে।
প্রধান বিচারপতি শুধুমাত্র বিচার বিভাগের শীর্ষপদই নয়, তিনি প্রজাতন্ত্রের প্রধান বিচারপতি। প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত; এতো উঁচু মর্যাদার আর কোনো সম্মানজনক পদ নেই। ফলে অবসরের পর প্রধান বিচারপতির মর্যাদা সুরক্ষার প্রয়োজনেই প্রজাতন্ত্রের লাভজনক পদে নিয়োগ দেওয়ার বিধান সংবিধানে রাখা হয়নি।
বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগের প্রভাবের বাইরে রাখার মধ্যেই নিহিত আছে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ তত্ত্ব। বিচারবিভাগ পৃথকীকরণ সংবিধানের basic structure। এটাই প্রজাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। বিচার বিভাগের মর্যাদা সুরক্ষিত না হলে সংবিধানের basic structure আঘাতপ্রাপ্ত হবে এবং সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব বিনষ্ট হবে। বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি যদি যুগ্মসচিবের সমকক্ষ বা প্রজাতন্ত্রের কর্মের যে কোনো পদ গ্রহণ করেন, তাহলে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বা ভারসাম্য নষ্ট হবে। বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়া মানে রাষ্ট্রকে বিপজ্জনক অবস্থায় ঠেলে দেওয়া। যা কারো কাম্য হতে পারে না।
সংবিধানকে আইনগত দিক ছাড়াও দর্শনগত দিক বা নৈতিকভাবে বিবেচনা করতে হয়। সংবিধানকে নৈতিকভাবে গ্রহণ করতে না পারলে, সংবিধানের অন্তর্নিহত নৈতিকশক্তিকে অনুধাবন করতে না পারলে, সংবিধানের শিষ্টাচারকে প্রাধান্য না দিলে কোনোক্রমেই সংবিধানকে কার্যকর করা যায় না। যদি আইন থাকে অথচ আইনের প্রয়োগ না থাকে, তবে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব নস্যাৎ হয়।
বাংলাদেশের বিদ্যমান বাস্তবায় বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগের রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত রাখার প্রয়োজনে এবং বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের মৌলিক নীতি অনুসরণে ‘৭২ সালের মূল সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদ আবার পুনর্বহাল করা জরুরী প্রয়োজন।
লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক