বেসরকারিভাবে ‘বৈষম্যবিরোধী হজ এজেন্সি মালিকবৃন্দ’র ব্যানারে এবার সাধারণ হজ প্যাকেজ, সাধারণ হজ প্যাকেজ-২ এবং বিশেষ হজ প্যাকেজ নামে আরও তিনটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হলো।
বৃহস্পতিবার ৭ নভেম্বর দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে পাল্টা এই প্যাকেজ ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী হজ এজেন্সির মালিকরা।
এর আগে সরকারিভাবে দুটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করার পর বুধবার বেসরকারিভাবে অন্য এজন্সির মালিকরা দুটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে -হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) এর ব্যানারে।
সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী হজ এজেন্সির মালিকদের আহ্বায়ক মো. আখতার উজ্জামান বলেন, সংকটাপন্ন হজ ব্যবস্থাপনা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা একটি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। গত বছরের চেয়ে এবার হজের খরচ কমানোয় আমরা যেমন খুশি তেমনি এই খরচ আরও কমানোর দাবি জানাচ্ছি।
নতুন ৩ টি হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে সংগঠনটি বলছে, উচ্চ আদালতের রায়ে হজ এজেন্সির হজ এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশনের (হাব) কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ রয়েছে। তাই ওই অংশের হজ প্যাকেজ দেওয়ার নৈতিক অধিকার নেই। একই সঙ্গে সরকার ঘোষিত হজ প্যাকেরে মূল্য আরও কমানোর দাবি জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ‘বৈষম্যবিরোধী হজ এজেন্সি মালিকবৃন্দ’-এর আহ্বায়ক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, তাদের ঘোষিত প্যাকেজের মধ্যে হজযাত্রীদের জন্য খাওয়াসহ ও কোরবানি ব্যতীত ‘সাধারণ হজ প্যাকেজ-১’-এর মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মোট ৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা। ‘সাধারণ হজ প্যাকেজ-২’-এর মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মোট ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া ‘বিশেষ হজ প্যাকেজ’-এর মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, সরকার বিমান ভাড়া ও অন্যান্য খরচ কমালে ওই পরিমাণ আমাদের প্যাকেজ মূল্য থেকেও কমে যাবে।
মো. আখতারুজ্জামান বলেন, একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন হলো হজ। জীবনে একবারের জন্য হলেও আল্লাহর ঘরের মেহমান হয়ে পবিত্র কাবার জিয়ারত ও সোনার মদিনায় হাজিরা দিয়ে সালাতু সালাম পেশ করা। একজন মুসলমানের শেষ চাওয়া এ মহান কাজটি সুন্দর ও সুচারুরূপে সম্পাদন করতে এজেন্সি মালিক ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরের আন্তরিক সহযোগিতা একান্ত জরুরি।
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে সঙ্কটাপন্ন হজ ব্যবস্থাপনা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মহোদয়ের অব্যাহত আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং হাব রক্ষার্থে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সমোচিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।’
‘বৈষম্যবিরোধী হজ এজেন্সি মালিকবৃন্দ’-এর আহ্বায়ক বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ফরজ এবাদত পবিত্র হজ পালনের কোটা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও বিগত কয়েক বছর যাবত নানা ধরনের অনিয়ম, নৈরাজ্যের মাধ্যমে বিমান ভাড়া ও হজ প্যাকেজ মূল্য অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি করে পুরো হজ ব্যবস্থাপনাকে সঙ্কটাপন্ন করে তোলা হয়।
যার ফলশ্রুতিতে ২০২৪ সালে প্রায় ৪৫ হাজার নিবন্ধিত হাজি পবিত্র হজ পালন থেকে বঞ্চিত হয়। এহেন দুরবস্থার উত্তরণ ঘটিয়ে ২০২৫ সালের হজ প্যাকেজ মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিমান ভাড়াসহ প্যাকেজ মূল্য কিছুটা কমলেও এখনো এ দেশের সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সাধ ও সাধ্যের মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে।
তিনি বলেন, ফলে আমরা এ বছরও কোটা পূর্ণ হওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছি। আবেগ অনুভূতি সম্বলিত ফরজ ইবাদত হজ পালনকে সহজতর করার জন্য বিমান ভাড়া আরও কমিয়ে ও সৌদি অংশের মুয়াল্লিম ফি এবং ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ভ্যাট/ট্যাক্স কমিয়ে আরও সুলভ প্যাকেজের দাবি জানাচ্ছি।
সঙ্গে সঙ্গে চলমান রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াকে বেগবান করার লক্ষ্যে বৈষম্যবিরোধী হজ্জ এজেন্সি মালিকবৃন্দের পক্ষ থেকে বেসরকারি হজ এজেন্সি মালিকদের জন্য নিম্নোক্ত প্যাকেজ সমূহ ঘোষণা করছি।
এরপর তিনি বিস্তারিত হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেন :
প্রথম প্যাকেজ মূল্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ১৮ হাজার, দ্বিতীয় প্যাকেজের মূল্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা এবং বিশেষ হজ প্যাকেজ ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
সাধারণ প্যাকেজ ৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা:
এই প্যাকেজটির সরকার ঘোষিত প্যাকেজের সঙ্গে মিল রেখে করা হয়েছে। সবার সামর্থ্যের মধ্যে রেখেই এ প্যাকেজটি মূল্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা। সৌদি রিয়ালের বিনিময় হার ৩২ টাকা ৫০ পয়সা হিসাবে ধরে এ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এই প্যাকেজে সৌদি অংশের খরচ ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩২ হাজার ৮০৭ টাকা। এর মধ্যে থাকবে মক্কা মদিনা বাসা ভাড়া, জমজম পানি, সার্ভিস চার্জ, খাওয়া খরচ ইত্যাদি। আর বাংলাদেশ অংশের খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩৫০ টাকা। এরমধ্যে রয়েছে বিমান ভাড়া ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮২০ টাকা। হজযাত্রীদের কল্যাণ তহবিল, প্রশিক্ষণ ফি, হজ গাইড ফি ইত্যাদি।
সাধারণ প্যাকেজে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাবেন
হজ ভিসা এবং সৌদি আরবে যাওয়া-আসার বিমান টিকিট সরবরাহ, মক্কা আল-মোকাররমায় পবিত্র মসজিদুল হারাম এর বাহিরের চত্বর হতে সর্বোচ্চ ৩ কিলোমিটারের এবং মদিনা আল মনোয়ারায় পবিত্র মসজিদে নববী থেকে সর্বোচ্চ দেড় কিলোমিটারের মধ্যে মারকাজিয়া এরিয়ার বাহিরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হোটেল/বাড়ি। প্রতি রুমে সর্বোচ্চ ৬ জনের আবাসন মিনার তাঁবুতে ম্যাট্রেস, চাদর, কম্বল ও বালিশের ব্যবস্থা, আরাফায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত তাঁবুর ব্যবস্থা, মিনা এবং আরাফায় মোয়াল্লেম কর্তৃক খাবার পরিবেশন, মক্কা-মিনা-আরাফাহ-মুজদালিফা যাতায়াতের জন্য বাসের ব্যবস্থা, হজযাত্রী ও গাইডদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান, হজ ও ওমরাহ নির্দেশিকা, আইডি কার্ড, লাগেজ ট্যাগ সরবরাহ, দেশে ফেরার পর বিমানবন্দর থেকে হজযাত্রীকে ৫ লিটার জমজম পানি সরবরাহ, কম-বেশি ৪৬ জন হজযাত্রীর জন্য ১ জন গাইড থাকবে এবং এজেন্সির সাথে আলোচনা করে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করে রুম আপগ্রেডেশন করা যাবে।
হজযাত্রীকে কুরবানি বাবদ আনুমানিক ৭৫০ সৌদি রিয়াল সঙ্গে নিতে হবে এবং কুরবানি নিজ দায়িত্বে সম্পন্ন করতে হবে, সৌদি আরবে সর্বনিম্ন ৩০ দিন সর্বোচ্চ ৪৮ দিন অবস্থান, মদিনায় ৫ হতে ৮ দিন অবস্থান, মুজদালিফায় নিজ ব্যবস্থাপনায় অবস্থান, নিয়মিত সেবন করতে হয় এরূপ ঔষধ ও চিকিৎসা সামগ্রী (ব্লাড সুগার টেস্টের স্ট্রিপ, নিডিল, ইনসুলিন, ডায়াবেটিক ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ঔষধ) চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রসহ কমপক্ষে ৫০ দিনের সঙ্গে নিতে হবে।
সাধারণ হজ প্যাকেজ-২ মূল্য ৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা
যারা দূরে না থেকে কাছাকাছি দূরত্বে থাকতে চায় তাদের জন্য এই প্যাকেজটি ঘোষণা করেছে মালিকরা। তাদের দাবি, হেরেম শরীফ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে যেতে অনেকে সমস্যা হবে। তাই যারা দেড় কিলোমিটারেরে মধ্যে থাকতে চায তাদের জন্য এই প্যাকেজটি সাজানো হয়েছে। তাদের দাবি, এ প্যাকেজটিতে সবাই পছন্দ হবে। সাধারণ প্যাকেজ ও সাধারণ প্যাকেজ-২ মধ্যে সুযোগ-সুবিধার দিকে থেকে শুধু মক্কা মদিনার দূরত্ব ইস্যুটি থাকবে। এই প্যাকেজে হেরেম শরীফ থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটারের হোটেলের ব্যবস্থা করা হবে।
বিশেষ প্যাকেজে মূল্য ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা
এ প্যাকেজটি সাধারণ ভিআইপি প্যাকেজ বলা হয়। এ প্যাকেজের মূল্য ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। আর সরকারিভাবে এ প্যাকেজের মূল্য ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০টাকা।
এই প্যাকেজে সৌদি অংশের খরচ ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৬৬৭ টাকা। এরমধ্যে থাকবে মক্কা মদিনা বাসা ভাড়া, জমজম পানি, সার্ভিস চার্জ, খাওয়া খরচ ইত্যাদি। আর বাংলাদেশ অংশের খরচ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৩৫০ টাকা। এরমধ্যে রয়েছে বিমান ভাড়া ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮২০ টাকা। হজযাত্রীদের কল্যাণ তহবিল, প্রশিক্ষণ ফি, হজ গাইড ফি ইত্যাদি।
এ প্যাকেজে যারা যাবেন তাদেরকে মক্কায় হারাম শরীফের বাইরের চত্বর থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে। হারাম শরীফ যাতায়াতে বাসের ব্যবস্থা থাকবে। একইভাবে মদিনায় মার্কাজিয়া (সেন্ট্রাল এরিয়া) এলাকায় আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে।
মিনায় ইয়োলো জোনে (জোন-২) তাঁবুর অবস্থান এবং মিনা-আরাফায় আপগ্রেডেড ‘ডি’ ক্যাটাগরির সার্ভিস সুবিধা, মক্কার হোটেল/বাড়ি হতে বাসযোগে মিনার তাঁবুতে এবং মিনা-আরাফাহ-মুযদালিফা-মিনা ট্রেনযোগে যাতায়াত, অ্যাটাচ বাথসহ মক্কা ও মদিনায় বাড়ি/হোটেলের প্রতি রুমে সর্বোচ্চ ৬ জনের আবাসন, বাড়ি/হোটেল কক্ষে/ফ্লোরে রেফ্রিজারেটর এর ব্যবস্থা, মক্কা, মদিনা ও জেদ্দায় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে ওষুধ ও প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করা এবং ৪৬ জন হজযাত্রীর জন্য ১ জন হজ গাইডের ব্যবস্থা করা হবে। প্রত্যেক হজযাত্রীকে খাবার বাবদ ন্যূনতম ৪০ হাজার টাকার সমপরিমাণ সৌদি রিয়াল এবং দমে শোকর (কোরবানি) বাবদ ৭৫০ সৌদি রিয়াল আবশ্যিকভাবে সঙ্গে নিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আখতার উজ্জামান বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ১ লাখ ২৭ হাজার কোটা দিয়েছে সৌদি সরকার। বিগত কয়েক বছর যাবত নানা ধরনের অনিয়ম, নৈরাজ্যের মাধ্যমে বিমান ভাড়া ও হজ প্যাকেজ মূল্য অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধি করায় পুরো হজ ব্যবস্থাপনাকে সংকটাপন্ন করে তোলা হয়। যার ফলশ্রুতিতে গেল বছর প্রায় ৪৫ হাজার নিবন্ধিত হজযাত্রী পবিত্র হজ পালন থেকে বঞ্চিত হয়। এই পরিস্থিতিতে ২০২৫ সালের হজ প্যাকেজ মূল্য সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধর্ম উপদেষ্টার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিমান ভাড়াসহ প্যাকেজ মূল্য কিছুটা কমলেও এখনও এ দেশের সর্বস্তরের মুসলমানদের সাধ ও সাধ্যের মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে। ফলে আমরা এ বছরও কোটা পূর্ণ হওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছি। আবেগ অনুভূতি সম্বলিত ফরজ ইবাদত হজ পালনকে সহজতর করার জন্য বিমান ভাড়া আরো কমিয়ে ও সৌদি পার্টের মুয়াল্লিম ফি এবং ১৭.৫০% ভ্যাট/ট্যাক্স কমিয়ে আরও সুলভ প্যাকেজের দাবি জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বৈষম্যবিরোধী হজ এজেন্সির মালিকদের সংগঠনের সদস্য সচিব মোহাম্মদ আলী, হাবের সাবেক মহাসচিব রশিদ শাহ সম্রাট প্রমুখ।
উল্লেখ্য, চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ৫ জুন ২০২৫ সালে পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হবে। এ বছর বাংলাদেশ থেকে সর্বমোট ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হজ পালন করবেন।