আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় আরও ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার ছাড় করবে। একই সঙ্গে নতুনভাবে আরও ৭৫ কোটি ডলার ঋণের বিষয়েও ঐকমত্যে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ও আইমএএফ প্রতিনিধি দল।
বুধবার ১৮ ডিসেম্বর আইএমএফের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড় করতে সংস্থাটি বাংলাদেশের সঙ্গে কর্মকর্তা পর্যায়ে প্রতিনিধিদলটি তাদের মিশন শেষে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি সংস্থার নির্বাহী বোর্ডে উঠবে।
এ প্রতিনিধিদলের দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আইএমএফের আগামী নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন সাপেক্ষে চতুর্থ কিস্তি ছাড় হবে। নতুন ঋণের বিষয়টিও ওই বোর্ড সভার অনুমোদন নিতে হবে।
উল্লেখ্য, চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে শর্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা ও নতুন ঋণের বিষয়ে দরকষাকষি করতে গত ৩ ডিসেম্বর থেকে আইএমএফ গবেষণা বিভাগের ডেভেলপমেন্ট ম্যাক্রোইকোনমিকসের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিওর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে।
সংস্থাটি মনে করছে, বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্যভাবে শ্লথ হয়ে পড়েছে। ফলে চলতি অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে।
আইএমএফ অবশ্য পূর্বাভাস দিয়েছে যে আগামী অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৫–২৬ অর্থবছরে অর্থনীতি চাঙা হবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হবে। চলতি বছরে মূল্যস্ফীতি বার্ষিক ভিত্তিতে ১১ শতাংশে থাকলেও আগামী অর্থবছরে তা দ্রুত কমে আসবে। ২০২৫–২৬ অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে দাঁড়াবে বলে সংস্থাটি মনে করছে।
আইএমএফ জানিয়েছে, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ চলমান ঋণ কর্মসূচির আকার আরও ৭৫ কোটি মার্কিন ডলার বাড়ানোর জন্য অনুরোধ করেছে। এর ফলে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) এবং বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ঋণের আকার দাঁড়াবে ৪০০ কোটি ডলারে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) কর্মসূচির আওতায় ১৩০ কোটি ডলার ঋণ পেয়েছে।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা এর আগে জানিয়েছিলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশ যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখী হয়েছে, তা মোকাবিলার জন্য অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন। কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন যে আইএমএফের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৩০০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে। চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় অতিরিক্ত অর্থের জন্য বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ যে অনুরোধ করেছে, তা পাওয়া গেলে এই কর্মসূচির আকার দাঁড়াবে ৫৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
প্রসংগত, আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি শুরু হয় ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি। এরপর তিন কিস্তিতে সংস্থাটি থেকে প্রায় ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। চতুর্থ কিস্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারি নাগাদ ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার পাওয়া যাবে। ২০২৬ সাল নাগাদ পুরো অর্থ পাওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের কাছাকাছি বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ)। একই সঙ্গে সঠিক নীতি গ্রহণ করা হলে ২০২৬ সালে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপে আছে। গণ-অভ্যুত্থান, বন্যা ও সংকোচনমূলক নীতি গ্রহণের কারণে বছর শেষে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে সময়মতো অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করায় ক্রমান্বয়ে অর্থনীতি স্বাভাবিক হচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে এখনো ধীরগতি ও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। ব্যাংক থেকে মূলধন বের হয়ে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে চাপে ফেলেছে। এছাড়া রাজস্ব আয় কমছে, যদিও বাড়ছে সরকারের ব্যয়ের চাপ। এসব চ্যালেঞ্জ আর্থিকখাতকে দুর্দশার মধ্যে ফেলছে বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
কর অব্যাহতি অপসারণ, অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের রাশ টেনে ধরা, মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা, বিনিময় হার আরও নমনীয় করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে কর–রাজস্ব অনুপাত কম। তাই একটি স্বচ্ছ ও ন্যায্য রাজস্ব–ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জরুরি ভিত্তিতে রাজস্ব–সংক্রান্ত সংস্কার করতে হবে।
ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর করার পরমার্শ দিয়ে আইএমএফ বলেছে, দ্রুত যেসব কাজ করতে হবে তার মধ্যে রয়েছে সঠিকভাবে খেলাপিঋণ চিহ্নিত করা, বর্তমানে যেসব নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা রয়েছে তার কার্যকর বাস্তবায়ন এবং আর্থিক খাতে পুনর্গঠনের জন্য একটি রোডম্যাপ বা পথনকশা তৈরি করা। আর্থিক খাতের সংস্কার কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সুশাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে সংস্থাটি।
এ ছাড়া বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা, বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে রপ্তানি খাত আরও বৈচিত্র৵ করতে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের পাশাপাশি সুশাসন বৃদ্ধি করতে পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
এর আগে আজ বিকেলে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালোউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ প্রতিনিধি দল।