বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে নিহত নারী সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রী অথবা বৃষ্টি খাতুন আসলে কে?
পরিচয় নিয়ে ধোয়াশায় তার লাশ এখনো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
তার পিতা দাবীকারী সবুজ শেখের মতে তার নাম বৃষ্টি খাতুন। ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমেও তার নাম জানা যায় বৃষ্টি খাতুন। এছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্রেও নাম রয়েছে বৃষ্টি খাতুন। বাবার নাম সবুজ শেখ, মায়ের নাম বিউটি বেগম। বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বনগ্রাম গ্রামে।
অন্যদিকে একটি চাকরির সিভিতে লেখা রয়েছে তার নাম অভিশ্রুতি শাস্ত্রী, বাবার নাম অভিরূপ শাস্ত্রী এবং মায়ের নাম লিখেছেন অপর্ণা শাস্ত্রী। সিভিতে তিনি নিজের বর্তমান ঠিকানা লিখেছেন সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির, মৌচাক। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়াতেও তিনি তার নাম ব্যবহার করতেন অভিশ্রুতি শাস্ত্রী।
এই পরিচয় বিভ্রাটের কারণে তার লাশ হস্তান্তর নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন। তাই ডিএনএ টেস্ট রিপোর্ট পাওয়ার পর অভিশ্রুতির লাশ হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এদিকে ওই নারী সাংবাদিকের পরিচয় নিয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। কয়েকদিন ধরেই দেখা যায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক নারী শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট মর্গের সামনে। তিনি নিজেকে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী বা বৃষ্টি খাতুনের বান্ধবী হিসেবে পরিচয় দেন।
নাম পরিচয় গোপন করার শর্তে ওই নারী গণমাধ্যমকে বলেন, কয়েকমাস আগেও ওই নারী সাংবাদিকের নাম ছিল অভিশ্রুতি বৃষ্টি। ২০১৯ সাল থেকে আমাদের পরিচয়। আমি ওর থেকে দুই বছরের বড়। তাকে অনেক বিষয় নিয়ে পরামর্শ দিতাম। তার পারসোনাল জীবন সর্ম্পকে অনেক কিছু জানতাম।
তিনি বলেন, ২০২১ সালে তার মায়ের সাথে আমার কথা হয়। তার মা আমাকে ফোন করে। ওর আসল সমস্যা কী তা আমার কাছে জানতে চান। আমি তার মাকে বলি- আন্টি আপনার মেয়ের কোনো দোষ নাই, এটা টিনএজ বয়সে এ রকম একটু-আধটু হয়ে থাকে।
তার আসল নাম কী জানতে চাইলে বৃষ্টির বান্ধবী জানান, আমি ২০১৯ সাল থেকে দেখছি সে অভিশ্রুতি বৃষ্টি নামেই ছিল। হয়ত ৩/৪ মাস আগে সে ফেসবুকে তার নাম চেঞ্জ করতে পারে। তবে প্রেমের কারণে তার নাম চেঞ্জ করতে পারে বলে জানান তার ঘনিষ্ট বান্ধবী।
এদিকে এনআইডি সূত্রে জানা গেছে, অগ্নিকাণ্ডে নিহত অভিশ্রুতি নামের ব্যক্তি বাস্তবে বৃষ্টি খাতুন। তিনি তার জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) সংশোধন চেয়ে আবেদন করেছেন। আবেদনটি ‘গ’ ক্যাটাগরিতে আছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এনআইডি সংশোধন আবেদনে জানা যায়, বর্তমান এনআইডি অনুযায়ী তার নাম আছে বৃষ্টি খাতুন, বাবার নাম সবুজ শেখ। এনআইডি সংশোধনে তিনি নিজের নাম বৃষ্টি খাতুন থেকে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী ও পিতার নাম সবুজ শেখ থেকে মো. শাবরুল আলম এবং জন্মসাল ১৯৯৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ২০০০ সালের ২৫ ডিসেম্বর সংশোধন চেয়েছেন। অভিশ্রুতি শাস্ত্রী (বৃষ্টি খাতুন) গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নিজ নাম, পিতার নাম ও জন্মসাল পরিবর্তন চেয়ে আবেদন করেন। আবেদনটি বর্তমানে ‘গ’ ক্যাটাগরিতে আছে।
জাতীয় পরিচয়পত্রে এসব তথ্য সংশোধনের জন্য ২০২২ সালের নিবন্ধন করা জন্মসনদ, পিতার এনআইডি, মাতার এনআইডি ও ইউনিয়ন পরিষদের নাগরিকত্ব সনদ দাখিল করেছেন। তবে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী যে জন্মসনদ দিয়ে আবেদন করেছিলেন সেটি ভুয়া ছিল।
সংশোধন আবেদনে দাখিলকৃত পিতা-মাতার এনআইডি অনুযায়ী হাসপাতালে নিজের মেয়ে দাবি করা মো. শাবরুল আলম সঠিক বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অন্যদিকে ওই নারী সাংবাদিকের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকশায় চলছে শোকের মাতম। তার মা, বাবা, বোন, পাড়া প্রতিবেশি এমনকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও বলছেন বৃষ্টি সবুজ শেখের মেয়ে। সবুজ শেখ বলেন, ব্ল্যাড টেস্ট করা হবে যদি সত্য না হয়, আমি আইনের আশ্রয় নেব। এক নারী প্রতিবেশি বলেন, এই ছবি বৃষ্টির। আমি এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকেই তাকে দেখছি। ও সবুজ চাচারই মেয়ে। প্রমাণ হিসেবে দেখান স্কুল কলেজ ও স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেট। তার ছোট বোনের প্রশ্ন, কেন তার বোনকে ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে না। অবিলম্বে তার বোনকে ফেরৎ চান ওই সাংবাদিকের ছোট বোন। বৃষ্টি ওরফে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়েছেন গ্রামের বিদ্যালয়ে। উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকার ইডেন কলেজে দর্শন শাস্ত্র নিয়ে পড়ছিলেন।
তবে ভিন্ন আরেক দাবি করেছেন রমনার কালি মন্দিরের সভাপতি উৎপল সহা। তিনি জানান, আমাদের সাথে তার মন্দিরের কানেকটিভিটি বা কাজের সম্পৃক্ততা ছিল। সবুজ শেখ মিথ্যা কথা বলছেন, অভিশ্রুতির প্রকৃত বাড়ি ভারতের বানারসে। গত আট মাস ধরে সে এই মন্দিরে অনেকটাই কানেকটেড।
তবে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী ওরফে বৃষ্টি খাতুনের কোনো পাসপোর্ট ছিল না বলে জানান তার বান্ধবী। তিনি বলেন, বৃষ্টির কোনো পাসপোর্ট ছিল না। তবে কীভাবে পাসপোর্ট করতে সে বিষয়ে আমাদের একাধিকবার কথা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বেইলি রোডের একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন নিহত হন। এর মধ্যে ওই নারী সাংবাদিকও ছিলেন।