অন্তর্র্বতী সরকারের নির্দেশনার পরও কর্মস্থলে ফেরেননি আওয়ামী লীগ আমলে আলোচিত-সমালোচিত ডিআইজি মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকারসহ পুলিশের ১৮৭ সদস্য।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন থেকে গতকাল ৭ অক্টোবর পর্যন্ত অনুপস্থিত রয়েছেন পুলিশের ১৮৭ জন সদস্য।
কাগজপত্রে পুলিশ বাহিনীতে তাদের চাকরি রয়েছে এখনো; কিন্তু অন্তর্র্বতী সরকারের দুই মাসেও তারা কর্মস্থলে যাননি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কর্মস্থলে না আসায় তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাচ্ছে সরকার।
এ তালিকায় রয়েছেন পুলিশের বহুল আলোচিত ডিআইজি মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ আর অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকারও। এই দুই কর্মকর্তাসহ ১৮৭ সদস্যের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
কর্মস্থলে উপস্থিত না হওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজন ডিআইজি, ৭ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, দুজন পুলিশ সুপার, একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ৫ জন সহকারী পুলিশ সুপার, ৫ জন পরিদর্শক, ১৪ জন উপপরিদর্শক ও সার্জেন্ট, ৯ জন সহকারী উপপরিদর্শক, ৭ জন নায়েক ও ১৩৬ জন কনস্টেবল রয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, এরইমধ্যে পুলিশের ওই ১৮৭ সদস্যের বেতন স্থগিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। কেন তারা কর্মস্থলে উপস্থিত হচ্ছেন না- নিয়ম অনুযায়ী এজন্য তাদের শোকজ করা হবে। ‘সন্তোষজনক’ জবাব না পেলে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে ধাপে ধাপে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ওই কর্মকর্তা জানান, এই তালিকার মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমনে গুলি করে হত্যার ঘটনায় একাধিক মামলা রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সহজ হবে।
গতকাল সোমবার আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম জানিয়েছেন, পুলিশ বাহিনীতে যারা এখনো কাজে যোগদান করেননি তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু হয়েছে। যারা কাজে যোগ দেননি তাদের নোটিশ করা হয়েছে। তারা যদি না আসেন আমাদের অবস্থা ক্লিয়ার, তাদের চাকরিতে রাখার সুযোগ নেই।
আইজিপি জানান, যারা (পুলিশ সদস্য) বিভিন্ন মামলায় আসামি হয়েছেন, যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে এমন ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা কর্মস্থলে যোগ দেননি তারা হয়তো মামলার কারণে কিংবা অন্য কারণে যোগ দেননি।
সূত্র জানায়, পলাতক তালিকায় একমাত্র ডিআইজি বহুল আলোচিত হারুন অর রশীদ রয়েছেন। পুলিশ ক্যাডারের ২০ ব্যাচের এই বিতর্কিত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনের প্রথম সারির কয়েক সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে নানা নাটকের জন্ম দেন তিনি। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে তাকে ডিবির পদ থেকে সরিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপারেশন বিভাগে অতিরিক্ত কমিশনার করা হয়। সেখানে থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত আন্দোলন দমাতে নানা ধরনের কার্যক্রম চালান তিনি।
পুলিশ সূত্র জানায়, বহুল আলোচিত এই হারুন ৫ আগস্টও রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার নির্দেশ দেন। ওইদিন তিনি ডিএমপির কন্ট্রোল রুমে বসে সব পরিস্থিতি দেখেন এবং শেষ সময় পর্যন্ত পুলিশকে আক্রমণ চালাতে নির্দেশ দেন। লাখো জনতা গণভবনের দিকে যেতে থাকলে ওই এলাকায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের অ্যাকশনে যাওয়ারও নির্দেশ দেন। তবে টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার ভারত চলে যাওয়ার খবরে বিমর্ষ হয়ে নিজেও কন্ট্রোল রুম থেকে পালানোর চেষ্টা করেন।
পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, এক পর্যায়ে পুলিশের কন্ট্রোল রুমের দেয়াল টপকে হারুন সেদিন পুলিশ সদর দপ্তরে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পালানোর চেষ্টা করলেও তাকে নেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেদিন তিনি মাস্ক পরে পুলিশ সদর দপ্তরের দেয়াল টপকে পালিয়ে যান।
এদিকে ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট পর্যন্ত হারুনের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন সক্রিয় পাওয়া যায়। ওইদিন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন তিনি পালিয়ে যাননি, দেশেই রয়েছেন। তবে এরপর থেকে তার হদিস মিলছে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে তথ্য এসেছে, হারুন ছাত্র-জনতার হামলার শিকার হয়ে গোপনে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে এসব তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ডিআইজি হারুন ছাড়াও পলাতকদের তালিকায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আরেক পুলিশ কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকার। তাকে শেষদিকে ডিবির যুগ্ম কমিশনারের দায়িত্বে আনা হয়েছিল। ৫ আগস্টের পর তারও হদিস মিলছে না। এরইমধ্যে খবর বেরিয়েছে, বহুল আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার অবৈধ পথে পালিয়েছেন।
এছাড়া কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অতিরিক্ত ডিআইজি) খন্দকার নুরুন্নবী, যুগ্ম কমিশনার এসএম মেহেদী হাসান ও যুগ্ম কমিশনার সঞ্জিত কুমার রায় রয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের আগে-পরে সংঘটিত হতাহতের ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে।
৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক পুলিশের এই সদস্যদের কাজে যোগ দিতে বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফায় সময় বেঁধে দেয় সরকার। অনেকে কাজে যোগ দিয়ে অসুস্থতাজনিত ছুটিতে চলে গেলেও গতকাল পর্যন্ত ১৮৭ জনের হদিস নেই পুলিশ সদর দপ্তরে।
সর্বশেষ পলাতক এই ১৮৭ সদস্যদের বিষয়ে গত ১ অক্টোবর সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, যেসব পুলিশ সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তারা আর পুলিশ সদস্য নন, তারা অপরাধী হিসেবে গণ্য হবেন।