যুক্তরাজ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। কয়েক মহাদেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তার এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে কয়েকশ বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়িসহ আরো অনেক কিছু।
কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্প্রচারমাধ্যম আল–জাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’ শিরোনামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে আল–জাজিরা। অনুসন্ধান করেছে আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দল ‘আই ইউনিট’।
ভিডিও প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র ১৩০০ ডলার বেতন পাওয়া মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ির মালিক। এর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষস্থানীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা। বাড়িগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য ৩২ কোটি ডলার। বাংলাদেশি টাকায় এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়েও তার সম্পদ রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান লন্ডনের বাইরে দুবাইয়ে ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ৫৪টি সম্পদের মালিক হন। যুক্তরাষ্ট্রেও তাঁর সম্পত্তি আছে। সেখানে তিনি নয়টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। এর মধ্যে পাঁচটি ম্যানহাটানসহ নিউইয়র্কের প্রধান এলাকায় এবং চারটি নদীর ওপারে নিউ জার্সিতে। সাইফুজ্জামান চৌধুরী তাঁর মোট সম্পত্তির এক–চতুর্থাংশ, ৮০টির বেশি যুক্তরাজ্যের শীর্ষ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বার্কলি হোমস থেকে কিনেছেন।
লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর হয়ে সব সম্পদ দেখাশোনা করেন চট্টগ্রামের রিপন মাহমুদ। সাইফুজ্জামান সিঙ্গাপুরের ব্যাংক ডিবিএস থেকে ঋণ নিয়েছেন। ওই ব্যাংকের কর্মী রাহুল মার্টের বর্ণনায়ও সাইফুজ্জামানের সম্পদের বর্ণনা উঠে এসেছে। কীভাবে তিনি বিদেশে এত সম্পদ গড়েছেন, সেই ধারণাও পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৭ সালের দিকে সম্পত্তি কেনা বাড়িয়ে দেন। ২০১৯ সালে যখন তিনি মন্ত্রী হন, তখন এটি আরও বাড়ে। বাংলাদেশে সাইফুজ্জামানের সম্পদের উৎস তার ব্যবসা ও ইউসিবি ব্যাংকের শেয়ার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান দেশের বাইরের এত পরিমাণ সম্পদ তাঁর নির্বাচনী হলফনামা ও ট্যাক্স ফাইলে গোপন করেছেন।
প্রতিবেদনে, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বর্ণনায়ও তার সম্পদ ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। সাইফুজ্জামান ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুবই কাছের ও বিশ্বস্ত। তিনি ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী হন। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে ভূমিমন্ত্রী করেন। সাইফুজ্জামান আল-জাজিরার সাংবাদিকদের বলেন, 'আমার বাবা প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) খুব কাছের লোক ছিলেন। সত্যি বলতে, আমিও তা-ই। …উনি আমার বস…উনি জানেন এখানে (ব্রিটেনে) আমার ব্যবসা আছে।'
দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর বুধবার আলজাজিরার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। যা বাংলাদেশি অর্থে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার সমান। ব্রিটেন ছাড়াও নিজের রিয়েল স্টেট ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া পর্যন্ত। সবমিলিয়ে তিনি পাঁচশরও বেশি বাড়ি কিনেছেন। যেগুলোর মূল্য প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার।
কাতারভিত্তিক এই সংবাদমাধ্যম বলেছে, গত বছর বিনিয়োগকারীর ছদ্মবেশে তাদের সাংবাদিক সাইফুজ্জামানের ১৪ মিলিয়ন ডলারের বাড়িতে যায়। ওই সময় ‘ছদ্মবেশী’ সাংবাদিকদের সাইফুজ্জামান বড়াই করে জানান, তিনি কুমিরের চামড়ার হাতে তৈরি জুতার ওপর হাজার হাজার ডলার খরচ করেন এবং লন্ডনের সবচেয়ে দামী দোকান থেকে ইতালিয়ান স্যুট তৈরি করে পরেন।
ভিডিওর একপর্যায়ে স্যুট পছন্দ করেন জানিয়ে সাইফুজ্জামান বলেন, তিনি লন্ডনে গেলে প্রতিবারই ২-৩ হাজার পাউন্ড খরচ করে স্যুট কেনেন। আর সুপার ২০০ ও সুপার ১৮০-র মতো স্যুট তার বিশেষ পছন্দের। 'একটা সুপার ২০০ স্যুটের খরচ পড়ে ৬ হাজার পাউন্ড (৮ হাজার ডলার),' বলেন তিনি।
আল-জাজিরার সাংবাদিকদের নিজের পেন্টহাউসও ঘুরে দেখান সাইফুজ্জামান। তিনি বলেন, 'এটা একেবারেই প্রাইভেট বাড়ি। নিজের নিরাপত্তার জন্য আমার খুব নিরাপদ বাড়ি দরকার।'
পাঁচতলা বাড়িটিতে একটি হোম থিয়েটার, একটি জিম, একটি 'প্রাইভেট লিফট' এবং গ্যারেজে পার্ক করা 'নতুন রোলস রয়েস' রয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে এত টাকা কীভাবে আনলেন, এ প্রশ্নের জবাবে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, আমার দুবাইয়ে রিয়েল এস্টেট কেনাবেচার ব্যবসা আছে। দুবাই থেকে এখানে টাকা আনি। এরপর এখান থেকে একটা ঋণ নিই।
আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সরকার সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার তার বিরুদ্ধে এখন অর্থপাচারের অভিযোগ এনে তদন্ত শুরু করেছে। তার পরিবারের মালিকানাধীন ইউসিবিএল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইতোমধ্যে তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ এবং তার পরিবারের মালিকানাধীন ইউসিবিএল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
সাইফুজ্জামানের বর্তমান অবস্থান অজানা। তবে বাংলাদেশ ছেড়েছেন বলে একটি কথোপকথনে তিনি উল্লেখ করেছেন।এছাড়া ছাত্র-জনতার গণবিপ্লবের মুখে যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যান তখন সাইফুজ্জামানও দেশে ছেড়ে চলে যান।
আলজাজিরার ইউটিউব অ্যাকাউন্ট ও ওয়েবসাইটে সাইফুজ্জামানকে নিয়ে বিস্তারিত ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
সূত্র: আলজাজিরা।