ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ছয় ঋতুর মাঝে সবচেয়ে উষ্ণতম হল গ্রীষ্মকাল। আমাদের দেশে বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য দুই মাস গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মকালকে ফলের ঋতুও বলা হয়। অনেকে আবার এই মাসকে মধু মাস বলে থাকে।
গ্রীষ্মকালে অনেক রকমের রসালো ফলমূল পাওয়া যায়। এই সময় আম, জাম, লিচু, কাঠাঁল, লটকন, তালের শাঁস প্রভৃতি রসালো ফলে ভরা থাকে এই সিজন। গ্রীষ্মকালীন ফলগুলো যেমন উপাদেয়, তেমনি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ।
আসুন জেনে নিই বিভিন্ন ফলের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা।
আম: মিষ্টি এ ফলের ১০০ গ্রামে ৪০০ ইউনিট ভিটামিন এ, ১২ গ্রাম শর্করা, ১৩ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি থাকে। পাকা আমের ৬০ শতাংশের বেশি ক্যারোটিন, যা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাকে মজবুত করে। কাঁচা আমে থাকা ফাইবার পিকটিন কোলেস্টেরলসহ হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায়, কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময় করে। আমে থাকে প্রচুর অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, যা তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।
আমে থাকা সোডিয়াম দেহের পানির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আমের মেলিক ও টারটারিক অ্যাসিড দেহের অ্যালকালিন লেভেল ঠিক রাখে। আমে থাকা ভিটামিন-এ চোখকে ভালো রাখতে সহায়তা করে এবং রাতকানা প্রতিরোধ করে। এছাড়াও আমে বিদ্যমান ভিটামিন-এ চুল ও ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে।
আমের মধ্যে আয়রন থাকে যা রক্তস্বল্পতা বা অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি এবং গর্ভবতী মহিলাদের জন্য খুবই উপকারী। আমে রয়েছে ভিটামিন- বি৬ যা মস্তিষ্কের উন্নতি ঘটায়। আমের মধ্যে বিদ্যমান ক্যারোটিনয়েডস, অ্যাসকরবিক এসিড, টার্পিনয়েডস এবং পলিফেনল এইসব অ্যান্টিক্যান্সার বৈশিষ্ট্যযুক্ত।
জাম: দেশীয় ফলের মধ্যে কালোজাম অন্যতম। এই ফলের পুষ্টিগুন অনেক। প্রচুর আয়রন ও ভিটামিন সি আছে এই ফলে। রক্তস্বল্পতা দূর করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। এতে শর্করা খুব কম। তাই ডায়াবেটিস রোগী নিশ্চিন্তে জাম খেতে পারেন। জামের বিচি রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। জামের বিচি ও জাম নিয়মিত সেবনে রক্তের সুগার লেভেল ৩০% কমায়। জাম দেহের যেকোনো সংক্রমণ প্রতিরোধেও সাহায্য করে।
একটি গবেষনায় দেখা গিয়েছে, জামে গুকোজ, ফ্রুক্টোজ এবং ডেক্সটোজ আছে যা আমাদের ক্লান্তিভাব দূর করে শরীরে শক্তি জোগায়, জামে প্রচুর পরিমানে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে যা ক্যান্সার সেল গঠনে বাঁধা দেয়। জামে বিদ্যমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এলজিক এসিড এন্থোসায়ানিন এবং এন্থোসায়ানিডিস শরীর থেকে বাজে কোলেস্টেরল দূর করার সাহায্য করে।
লিচু: লিচু সুস্বাদু রসালো ফল। দেহের পানির চাহিদা ও পিপাসা মেটাতে খুবই কার্যকর। প্রতি ১০০ গ্রাম লিচুতে রয়েছে ৮৪ দশমিক ১ শতাংশ জলীয় অংশ। এছাড়া ১০০ গ্রাম লিচুতে ১৩.৬ গ্রাম শর্করা থাকে। ক্যালসিয়াম আছে ১০ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন সি ৩১ মিলিগ্রাম। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে হাঁড় গঠনে সহায়তা করে। দাঁতকে মজবুত করে এবং শরীরে পানির ঘাটতি পূরনের মাধ্যমে দেহকে সতেজ রাখে।
কাঁঠাল: কাঠাঁল আমাদের জাতীয় ফল। মিষ্টি, রসালো এবং খেতেও অনেক সুস্বাদু এই ফল রুচি ও শক্তিবর্ধক। ১০০ গ্রাম কাঁঠালে ৯.৯ গ্রাম শর্করা, ২০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২১ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি থাকে। কাঁচা কাঁঠাল তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। এর দানা ভেজে কিংবা রান্না করে খাওয়া যায়।
এই ফলে পটাশিয়ামের ভালো উৎস রয়েছে যা উচ্চরক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। কাঠাঁলে রয়েছে ভিটামিন -সি এবং ভিটামিন-এ। এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ভিটামিন-সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সেই সাথে চুল, দাঁত ও দাঁতের মাড়ি সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।
এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে সর্দি কাশি রোগ সংক্রমন থেকে রক্ষা করে। কাঠাঁলে থাকা ভিটামিন- বি ৬ হৃদরোগ এর ঝুঁকি কমায়। এই ফলে বিদ্যমান আঁশ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সহায়তা করে। কাঁঠালে রয়েছে খনিজ উপাদান আয়রন যা দেহের রক্তস্বল্পতা দূর করে, কাঁঠালে থাকা ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস আলসার, ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সহায়তা করে।
লটকনঃ লটকনে ক্যালরি ও ফ্যাট কম থাকে তাই ডায়াবেটিস রোগীর জন্য উপকারী। অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে এটি। রুচি বাড়াতে, বমি বমি ভাব দূর করতে এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে, এতে বিদ্যমান পটাসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখে। এতে রয়েছে ভিটামিন-সি, যা স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এছাড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ভিটামিন-সি।
তালের শাস: একে কচি তাল ও বলা হয়। ভিটামিন বি-কমপ্লেক্সের আধার তালের আঁশ অত্যন্ত রসালো ও সুস্বাদু ফল। কোষ্ঠকাঠিন্য ও অন্ত্রের রোগে বেশ উপকারী। তাল দিয়ে বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার যেমন তালের ক্বাথ, জুস, বড়া, কেক, পিঠা ইত্যাদি তৈরি করে খাওয়া যায়।
১০০ গ্রামের তালের শাঁসে ৯২ দশমিক ৩ শতাংশই থাকে জলীয় অংশ। যা এই গরমে শরীরকে ঠান্ডা ও সতেজ রাখতে সহায়তা করে। শরীরের পানির ঘাটতি মেটাতেও সহায়তা করে, এতে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম হাড় গঠন ও হাড়ের রোগ প্রতিরোধ সহায়তা করে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ভিটামিন-সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
এছাড়াও রয়েছে-
বেল: গরমে ঠান্ডা বেলের শরবতে প্রাণ জুড়ায়। দীর্ঘমেয়াদি আমাশয় ও ডায়রিয়ায় কাঁচা বেল ভালো ফল দেয়। অধিক আঁশ থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্য ও পাইলসের জন্য উপকারী। বেল ত্বকের ব্রণ ও সংক্রমণ সারাতে সাহায্য করে।
জামরুল, সফেদা, গাব, আনারস ইত্যাদি গ্রীষ্মকালীন ফলও নানা পুষ্টিগুণে ভরা।
সতর্কতা:
গ্রীষ্মকালীন ফল যেমন উপকারী ঠিক তেমনি এইগুলো অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণের ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে, বদহজম ইত্যাদি দেখা দিতে পারে । এই ফলগুলো যেহেতু রসালো এবং মিষ্টি সমৃদ্ধ তাই ডায়াবেটিস এর রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাবেন।
কাঁঠাল খুব সহজপাচ্য নয়। বেশি খেলে গ্যাস বা হজমজনিত সমস্যা হতে পারে। গ্যাসট্রিক ও পেটের সমস্যায় লিচু কম খাওয়াই ভালো।
কিডনি রোগীরা কাঁঠালের বিচি, পটাশিয়াম সমৃদ্ধ ফল যেমন তরমুজ এড়িয়ে চলবেন। ডায়াবেটিস রোগীরা যদি মিষ্টি ফল বেশি পরিমাণে খেয়ে ফেলেন, তবে সেদিন অন্যান্য শর্করা ৫০ ভাগ কমিয়ে ফেলবেন।