পৌষের শুরুতেই বেশ দাপট দেখাচ্ছে শীত। কমতে শুরু করেছে দিন-রাতের তাপমাত্রা। বাড়ছে শীতকালীন নানা রোগের প্রকোপ। সর্দি-কাশি, বুকে শ্লেষ্মা বা কফ জমার সমস্যা, জ্বর, গলা ব্যথা, খাবারে অরুচি, মাথা ব্যাথা, বার বার হাঁচি দেওয়ার মতো সমস্যায় স্বাভাবিক জীবন-যাপনে বেশ প্রতিবন্ধকতা দেখা দিচ্ছে।
তবে আবহাওয়া পরিবর্তনের এসময়ে একটু সচেতন হলেই আমরা ঘরেই প্রাকৃতিকভাবে এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে পারি। হালকা ঠাণ্ডা-জ্বর হতেই পারে। এনিয়ে খুব বেশি চিন্তার কিছু নেই।
শীতের সময় কমন অসুখ হলো সর্দিজ্বর, কাশি। এ ছাড়া নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা, অ্যালার্জি, চোখ ওঠা, ডায়রিয়া, খুশকি, খোসপাঁচড়া বা চর্মরোগ প্রভৃতিরও প্রকোপ বেশি দেখা দেয়। তবে শীত সামনে রেখে কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকলে এসব রোগের জটিলতা থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
ঠাণ্ডাজনিত রোগে উপসম দিতে আমাদের সাহায্য করতে পারে এমন কিছু পরামর্শ:
তরল পানীয়
ঠাণ্ডায় আমাদের নাক বন্ধ হয়ে থাকে। নিশ্বাস নিতে ও ঘুমাতে কষ্ট হয়। অনেক সময় গলা ব্যথা থাকায় খাবার খেতেও কষ্ট হয়। শরীর আদ্র রাখতে এসময় গরম তরল পানীয় পান করতে হবে। স্যুপ, হারবাল চা, কফি, মধু দিয়ে গরম পানি বারবার পান করুন।
সর্দি-কাশি-জ্বর
সর্দি-কাশি-জ্বর বা কমন কোল্ড শীতের সময়কার একটি সাধারণ রোগ। শরীরের অতিরিক্ত তাপ হলেই আমরা জ্বর বলি। সিজনাল জ্বর হলেও থার্মোমিটার দিয়ে নিয়মিত জ্বর মেপে একটি ছক করে লিখে রাখুন।
সর্দিজ্বর দেহের শ্বাসনালির ভাইরাসজনিত এক ধরনের সংক্রমণ। ঋতু পরিবর্তনের সময় এ রোগ বেশি দেখা যায়। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা যাদের কম তাদের এ রোগ বেশি হয়। হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এসব রোগ একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়ায়।
সর্দিজ্বর হলে প্রথমে নাকে ও গলায় অস্বস্তি লাগে, হাঁচি হয়, নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে। নাক বন্ধও থাকতে পারে। মাথাব্যথা, মাথা ভারী বোধ হওয়া, শরীরে ব্যথা, জ্বর, গলাব্যথা প্রভৃতি উপসর্গও দেখা যায়।
সর্দি-কাশি-জ্বর প্রতিরোধে করণীয় হলো :
সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হলে অন্যদের সঙ্গে, বিশেষ করে শিশুদের সঙ্গে মেলামেশায় সতর্কতা অবলম্বন করুন। হাঁচি দেওয়ার সময় বা নাকের পানি মুছতে রুমাল বা টিস্যু পেপার ব্যবহার করুন। রোগীর ব্যবহৃত রুমাল বা গামছা অন্যদের ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখুন। যেখানে সেখানে কফ, থুথু বা নাকের শ্লেষ্মা ফেলা যাবে না। প্রয়োজনমতো গরম কাপড় পড়ুন, বিশেষ করে তীব্র শীতের সময় কান ঢাকা টুপি এবং গলায় মাফলার ব্যবহার করুন।
তাজা, পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ এবং পর্যাপ্ত পানি পান করুন, যা দেহকে সতেজ রাখবে এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করবে।মাঝেমধ্যে হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করুন বা হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন।
একটি অতিরিক্ত বালিশ নিয়ে ঘুমান
ঠাণ্ডা লাগলে নিশ্বাস নিতে সমস্যা হওয়ায় ঘুম ঠিকমতো হয় না। দ্রুত সুস্থ হতে পর্যাপ্ত ঘুম অপরিহার্য্। এজন্য একটি অতিরিক্ত বালিশ মাথায় দিয়ে ঘুমান।
খাদ্য
এসময় একবারে না খেয়ে বারে বারে অল্প অল্প খাবার খেতে হবে। ভিটামিন ‘সি’ জাতীয় খাদ্য বেশি রাখুন প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায়। লেবু, কমলা, পেঁপে, পেয়ারা, আমলকি বেশি বেশি খান। ঠাণ্ডা কমবে আর খাবার খেতেও রুচি হবে।
এছাড়াও জ্বর কমে আসে ব্লুবেরি খেলে। এর বেটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ গাজর, মরিচ, পেঁয়াজ, আদা শরীর পরিষ্কার করে ব্রংকাইটিস ও অন্যান্য সংক্রমণ থেকে রক্ষায় সাহায্য করে। সরিষা, গ্রিন টি প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করে তাই নিয়মিত এগুলো খেতে হবে।
যাঁদের গলা ব্যথা, স্বরভঙ্গ, কণ্ঠনালির নানা সমস্যাসহ টনসিলের প্রদাহ বা টনসিলাইটিস রয়েছে, তাঁরা লবণ মেশানো হালকা গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করলে আরাম পাবেন। ঠাণ্ডা পানি পরিহার করে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন এবং গলায় গরম কাপড় বা মাফলার জড়িয়ে রাখুন। সেই সঙ্গে মাউথওয়াশ দিয়ে কুলি করলে ভালো থাকা যায়। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল ও সর্দি-কাশি থাকলে অ্যান্টিহিস্টামিন সেবন করা উচিত।
বাতব্যথা
আর্থ্রাইটিস বা বাতের সমস্যা শীতের সময় বেড়ে যায়। মূলত বয়স্কদেরই এ সমস্যা হয় বেশি। বিশেষ করে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা এনকাইলোজিং স্পন্ডিওলাইটিস, স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস, রি-অ্যাকটিভ আর্থ্রাইটিস, সোরিয়াসিটিস, অস্টিও আর্থ্রাইটিস রোগীদের শীতের সময় চলাফেরা বা মুভমেন্ট কম হয় বলে ব্যথার প্রকোপ বেড়ে যায়। বাতব্যথা প্রতিরোধে করণীয় হলো—
যথাসম্ভব গরম উত্তাপে থাকুন, সব সময় হাত ও পায়ের মোজা পরিধান করুন। ব্যয়াম ও খাদ্যাভাসের মাধ্যমে দেহের অতিরিক্ত ওজন থাকলে তা কমিয়ে আনুন। একটানা অনেকক্ষণ বসে না থেকে যতটুকু সম্ভব ঘরেই হালকা মুভমেন্ট করুন। প্রয়োজনে গরম পানি ব্যবহার করুন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। গরম ছেঁক দিন বা ফিজিওথেরাপি নিন।
অ্যাজমা
হাঁপানি বা অ্যাজমাজাতীয় শ্বাসকষ্টের রোগ শুধু শীতকালীন রোগ নয়, তবে শীতে এর প্রকোপ অনেকাংশে বেড়ে যায়। অ্যাজমা একবার হলে এর ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হয় সারা জীবনই। তবে অ্যাজমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে জটিলতা বা ঝুঁকি থাকে না বললেই চলে। এ জন্য কিছু করণীয় হলো :
অ্যাজমার রোগীরা শীতে পর্যাপ্ত গরম জামা-কাপড়ের বন্দোবস্ত করুন।ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করুন। বিশেষ করে শোবারঘরটি উষ্ণ রাখার চেষ্টা করুন। অ্যাজমার ট্রিগারগুলো জেনে সতর্কভাবে চলুন।শীতের আগেই চিকিৎসককে দেখিয়ে ইনহেলার বা অন্যান্য ওষুধের ডোজ সমন্বয় করে নিন।
এছাড়া আরও যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে-
-অ্যান্টিসেপটিক দিয়ে হাত সব সময় পরিষ্কার করতে হবে।
-দাঁত মাজার ব্রাশ, চিরুনি, তোয়ালে এগুলো আলাদা রাখতে হবে।
-কাশি ও হাচিঁ দেওয়া সময় রুমাল ব্যবহার করুন।
-কুসুম গরম পানি পান করতে হবে।
-ঘরের ধুলা পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
-গোসল করতে অবশ্যই হালকা গরম পানি ব্যবহার করুন।
-আঙ্গুল দিয়ে ঘন ঘন নাক অথবা চোখ চুলাকানো যাবে না।
-নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করতে হবে।
-পরিবারের কেউ ঠণ্ডা জ্বরে আক্রান্ত হলে অন্যদের সাবধানে রাখুন। ভাইরাল ফেভারের সময় আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে খুব ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা না করাই ভালো। আর ছোটরা এবং বৃদ্ধদের শরীরে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। এদের জন্য নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা। যেমন, সন্ধ্যায় বাইরের বাতাসে না যাওয়া, গরম কাপড় ব্যবহার, ঠাণ্ডায় হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করা।
মনে রাখবেন সাধারণ ঠাণ্ডা দীর্ঘদিন না সারলে তা থেকে কোনো জটিল রোগ দেখা দিতে পারে। তাই উপসর্গগুলো দ্রুত সমাধান না হলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।