এলো বাংলা নতুন বছর ১৪৩১। শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ।
বাংলাদেশে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে নানান আয়োজনের মধ্য পান্তা উৎসব জনপ্রিয়। এর মাধ্যমে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার নগর সংস্কৃতি এখন জীবনের অনুষঙ্গ।
পান্তাভাত হলো পানিতে ভেজানো বাসি ভাত। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলে পান্তাভাত খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। কাঁচামরিচ-পেঁয়াজ দিয়েই লোকে পান্তা খেয়ে উঠত। অনেক সময় মানুষ পান্তা খেত শুধু লবণ মাখিয়ে।
আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা ভাত সাধারণত পরদিন সকালে পান্তাভাত হিসেবে খাওয়া হতো। এই পান্তা খাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের সানকি বা মাটির পাত্র ছিল না। তারা মাটির হাঁড়ি থেকে পান্তাভাত তুলে নিয়ে কচুপাতায় বা কলাপাতায় করে খেত।
আসলে, গরমে-রোদে কাজ করার জন্য কৃষকের উপযোগী খাদ্য ছিল এই পানিভাত। সূর্য ওঠার পরপরই পান্তাভাত খেয়ে তারা কাজে বের হতো। এরসঙ্গে কখনো কখনো যোগ হতো একটু বেগুনপোড়া বা আলুসেদ্ধ। খুব কম সময়েই পান্তাভাতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাছের তরকারি। মাছ বলতেও সেসব মাছ, যেগুলো সাধারণত খালে-বিলে সহজে পাওয়া যেত। যেমন— কুচো চিংড়ি, ছোট ট্যাংরা, পুঁটি, টাকি এগুলো।
দেখা যাচ্ছে, পান্তাভাতের চিংড়ির মতো সহজে লভ্য অন্য মাছও পান্তাভাতের অনুষঙ্গ হয়েছে। কিন্তু পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশের প্রসঙ্গ পাওয়া যায় না।
বাংলার জাতীয় মাছ ইলিশ কিন্তু দামি মাছ। ইলিশ যদি খেতেই হয়, তবে গরম ভাতেই খাওয়ার চল ছিল। সাধারণের পাতে সহজে ইলিশ উঠত না। তবে পান্তাভাতের সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার কোনো রীতি সাহিত্য কিংবা ইতিহাসে নেই।
আশির দশকে ঢাকায় পান্তাভাতে ইলিশ খাওয়ার চলটি তৈরি হয়েছে। এটি সারা দেশে জনপ্রিয় হতেও দেরি হয়নি। বাংলা বর্ষবরণের নাগরিক রুচিতে এখন ভর করেছে পান্তা-ইলিশ। উৎসবে মানুষ এক হতে চায়; শহরের মানুষও নতুন বছরের প্রথম দিনে এক হয়।
‘বৈশাখী মেলা’ নতুন বছরের মিলনের প্রধান উৎসব। ষাটের দশকে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে বাঙালি এক হয়েছে রবীন্দ্রসংগীতের সূত্রে নববর্ষ উদ্যাপনে। এরপর আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় মঙ্গল শোভাযাত্রার সূত্রে নগর মানুষ এক হয়েছে। এসব আয়োজন-অনুষ্ঠান যতই জনপ্রিয় হতে থাকে, ততই নাগরিক মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে রমনা-শাহবাগ এলাকায়।
আশির দশকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সুযোগটি গ্রহণ করেন। তারা নিজেদের আগ্রহে অস্থায়ী দোকান দিয়ে পান্তাভাত আর ভাজা ইলিশ বিক্রি শুরু করেন। পান্তাভাত হাজার বছরের বাঙালির প্রাত্যহিক খাদ্য, আর ইলিশ মূলত বঙ্গ-উপকূলের মাছ—এই ধারণা জাতীয়তাবাদী চেতনার সঙ্গে যুক্ত করে তারা পান্তা আর ইলিশকে জনপ্রিয় করেছেন।
যদিও একত্রভাবে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ঐতিহ্যিক কোনো সূত্র নেই। পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের সঙ্গে কাঁচা মরিচ ও পেঁয়াজ তো থাকেই, আরও থাকে আলুভর্তা, শুটকিভর্তা, বেগুনভর্তা ও পোড়া মরিচ। এসব খাবার পরিবেশনে ব্যবহার করা হয় ঐতিহ্যবাহী মাটির সানকিতে।
পহেলা বৈশাখের সঙ্গে ইলিশ মাছের আসলেই কোনও সম্পর্কের বিষয়টি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এখন সেই ভুল ভেঙেছে। এখন আর পহেলা বৈশাখ মানে পান্তা-ইলিশে সীমাবদ্ধ নয়।
তবে শহরের মানুষ যা নিয়েই মত্ত থাকুক না কেন, গ্রামের সাধারণ মানুষ নতুন বছরের প্রথম দিনে সাধ্যমতো ভালো খাওয়ার চেষ্টা করে। এদিন সকালে তারা মিষ্টি খেয়ে দিন শুরু করে। মজার ব্যাপার হলো, আগের রাতের খাবারে তারা তিতাজাতীয় কোনো পদ রাখে। এই তিতা খাবারটি তাদের কাছে পুরোনো বছরের দুঃখ-বেদনাকে বিসর্জন দেওয়ার প্রতীক।