বর্তমান সময়ে ‘ডিপ্রেশন’ খুবই পরিচিত একটি শব্দ। ইদানিং ছোট থেকে বড় যেকোনো বয়সের মানুষকেই এ সমস্যায় ভুগতে দেখা যায়। তবে ডিপ্রেশন কী অথবা কোনটি সত্যিকার অর্থেই ডিপ্রেশন তা এখনও আমাদের অনেকেরই অজানা। তাই মাঝেমধ্যে আমরা ছোট ছোট মন খারাপকেও ডিপ্রেশন ভেবে ভুল করি। কিন্তু ডিপ্রেশন আসলেই কি শুধু সাধারণ মন খারাপ, নাকি আরো গুরুতর কোনো সমস্যা? আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন কিনা তা যাচাই করতে চোখ রাখুন আজকের ফিচারে।
ডিপ্রেশন কী?
বিষন্নতা বা ডিপ্রেশন হলো মানুষের মনের একটি জটিল সমস্যা। অত্যাধিক ডিপ্রেশন অনেক সময় প্রাণনাশের কারণও হয়ে থাকে। যখন মন খারাপ বা হতাশাগ্রস্থতা একদম পিছুই ছাড়ে না, বরং দিন দিন তা মনের ওপর আরো বেশি করে চাপ তৈরি করে, তখনই সচেতন হতে হবে, কারণ এ অবস্থাই তৈরি করে বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশন দিনের পর দিন হওয়া খারাপ অভিজ্ঞতার সমন্বিত বহিঃপ্রকাশ। প্রতিদিনের বিভিন্ন ঘটনায় পাওয়া ক্রমাগত কষ্টের কারণে জীবনের প্রতি আগ্রহ কমতে থাকে এবং সেখান থেকেই ডিপ্রেশনের সূচনা হয়।
বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন একটি ভয়াবহ পর্যায়ের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে এ বিষয়টিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমলে নেয়া হয় না। মানুষ এ সমস্যার ব্যাপারে একেবারেই বুঝতে চান না এবং ভুক্তভোগীর প্রতি কোনো ধরনের সহানুভূতিও প্রদর্শন করেন না। বরং তারা বিভিন্ন অপবাদ ও ঠাট্টামূলক কথাবার্তা বলে তাদের মনের অবস্থাকে আরো জটিল করে তোলেন৷
আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন কি?
আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন কিনা কীভাবে বুঝবেন?
কেউ ডিপ্রেশনে ভুগছে কি না তা জানার কিছু লক্ষণ রয়েছে। আজ সেই লক্ষণগুলোই তুলে ধরবো:
১. কোনো কিছু করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলা:
যদি কারো কাজের প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনা কমে যেতে শুরু করে, তাহলে ধরে নেয়া যেতে পারে সে বিষণ্নতায় ভুগছে। যেসব শখের কাজ কেউ আগে করতে ভালোবাসতো এবং বেশ আগ্রহ নিয়েই করতো, সেই কাজ করতে আর তার কোনো উৎসাহ, উদ্দীপনা ও ভালো লাগা কাজ করে না।
২. নিজের অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রাখা:
যারা ডিপ্রেশনে ভোগে, তারা কাছের মানুষের সাথে বা প্রিয়জনদের সাথে নিজেদের সমস্যার কথা বলতে চায় না। এমনকি অনেক সময় তারা নিজেদের মনের অবস্থা নিজেরাই বুঝতে পারে না। “মনের কথা কিংবা মনের কষ্টগুলো লুকিয়ে রাখাই সব থেকে ভালো” -তারা এমন ধারণা পোষণ করে। নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে তাদের ভালো লাগেনা। তারা মনে করেন যে নিজেদের সমস্যাগুলো লুকিয়ে রাখাই শ্রেয়। তাই তারা নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে না। যতদিন সম্ভব তারা নিজেদের ভেতরেই পালিয়ে বেড়ায় এবং সমস্যাগুলোকে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত বাড়তে দেয়। এগুলোই তাদের পরবর্তীতে বিষণ্নতার দিকে আরো ঠেলে দেয়।
৩. ক্ষুধার ধরন বদলে যাওয়া
খাদ্যাভাসে পরিবর্তন বিষণ্নতার অন্যতম লক্ষণ। এ সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি হয় প্রচুর খাবার খাওয়া শুরু করেন আর না হয় খাবার খাওয়ার পরিমাণ একদম কমিয়ে দেয়। এতে তাদের ওজনেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে।
৪.ভালো বা খারাপ- কোনো অনুভূতিই না থাকা:
ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তির ভালো বা খারাপ থাকার নির্দিষ্ট কোনো অনুভূতি থাকে না। তারা ঠিকভাবে বলতে পারে না যে, তারা ভালো আছে নাকি খারাপ। “কেমন আছেন?” এই প্রশ্নের উত্তর দিতে যেয়ে তারা হয় দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে যায় আর না হয় একটি মেকি উত্তরই দিয়ে থাকে যে ,”ভালো আছি” অথবা “আমি তো সবসময় ভালোই থাকি’“। সত্যি বলতে অনেকেই পজিটিভ উত্তর দিতে এজন্য পছন্দ করেন যাতে প্রশ্নকর্তাকে এড়িয়ে যাওয়া যায়। আসলে তারা কেমন আছে সেটি তারা নিজেরাই সঠিকভাবে জানে না।
৫. জীবনের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি :
নিজের ভাবনার জগতে নিজেকেই হারিয়ে ফেলা, অবিন্যস্ত কথোপকথন, কথায় যুক্তি কিংবা আবেগ দু’টোরই প্রবল অভাব, কথা বলা কমে যাওয়া, কথা খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি ডিপ্রেশনের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। চিন্তা-ভাবনা ও তা প্রকাশের মাধ্যমেই একটি সফল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কিন্তু যখন ভাবনার গতি খুব ধীর হয়ে যায়, তখন সেভাবে কথাও আসে না আর সেই সাথে যোগাযোগেও দেখা দেয় অস্পষ্টতা। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের জীবন নিয়ে প্রচন্ড হতাশ থাকে। তারা জীবনে ঘটে যাওয়া সমস্ত সমস্যা ও ভুলের জন্য নিজেদেরকেই দায়ী করতে থাকে এবং জীবনে বেঁচে থাকাকে নিরর্থক মনে করে। এ ধরনের বিপজ্জনক চিন্তাভাবনাই তাদেরকে আত্মহননের পথ বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে এগিয়ে দেয়।
৬. স্বেচ্ছায় একটি প্রচন্ড ব্যস্ত জীবন বেছে নেয়া :
আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন কিনা তা বোঝার একটি উপায় হলো ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি সবসময় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায়, যাতে তাদের মনের ভেতরে থাকা কষ্টদায়ক অনুভূতিগুলো ও সমস্যাগুলো বারবার মনে না পড়ে। এমন ব্যস্ততার জীবন তারা বেছে নিতে চায় যাতে নিজের জন্য কোনো সময় না মেলে এবং এতে করে মনের গভীরে থাকা অনুভূতিগুলো যেন অতলেই চাপা পড়ে থাকে। ইচ্ছে করেই তারা অবসরের সময়টুকু রাখতে চায় না।
৭. অল্পতেই রেগে যাওয়া:
অন্য কারো অল্পতেই হাসি বা আনন্দের প্রকাশ তাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। সুখ দুঃখের অনুভূতিকে চাপা দিয়ে তাদের সকল আবেগের বিকল্প হয় রাগ। কেউ ভালো কথা বললেও যেন তাদের ভালো লাগে না, বরং আরো রাগ উঠতে থাকে। তারা অল্পতেই বা অকারণেই রেগে যায় আশেপাশের সবার ওপর, যার ফলশ্রুতিতে দূরত্ব সৃষ্টি হয় কাছের মানুষদের সাথে। তাদের তাৎক্ষণিক রাগের বহিঃপ্রকাশটা বেশ প্রবল হয়। এমনকি রেগে গেলে তাদের কাউকে আঘাত করা বা ভাংচুর করতেও দেখা যায়।
৮. ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করা:
বিষণ্ন ব্যক্তিদের মধ্যে বিশেষত পুরুষদের মধ্যে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা খুবই বেড়ে যায়। যেকোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেমনঃ খুব জোরে গাড়ি ড্রাইভ করা, রাস্তাঘাটে অন্যমনষ্ক থাকা, অতিরিক্ত মদ্যপান কিংবা ধূমপান করা, নিষিদ্ধ কাজে জড়িয়ে পড়া, নিজেকে আঘাত করা এবং নিজের প্রতি কোনো প্রকার সহানুভূতি না দেখানো ইত্যাদি। “যা ঘটে ঘটুক” তাদের ভেতর জীবন নিয়ে এমন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। সামাজিক আচার-আচরণ ও মানুষের সঙ্গকে তারা এড়িয়ে যায় এবং একসময় সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি এমনভাবেই নিজেদের প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ করে এবং নিজের বড়সড় ক্ষতি করে ফেলে।
৯. চিন্তাভাবনায় স্পষ্টতা না থাকা:
বিষণ্নতায় আক্রান্ত হলে সকল সমস্যা ও অনুভূতিগুলোকে চেপে রাখতে রাখতে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যে তারা ভালো করে কিছু চিন্তাও করতে পারেনা। চিন্তাভাবনায় খেই হারিয়ে ফেলা, অবিন্যস্ত কথোপকথন, কথাবার্তায় যুক্তি কিংবা আবেগ দুটোরই প্রবল অভাব, কথা বলা কমে যাওয়া, কথা খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদি ডিপ্রেশনের অন্যতম লক্ষণ। যখন তাদের ভাবনার গতি খুব ধীর হয়ে যায়, তখন সেভাবে কথাও আসে না আর যোগাযোগেও দেখা দেয় অস্পষ্টতা। এ ধরনের মানুষ প্রচন্ড সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। এমনকি দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো সিদ্ধান্ত নেয়াও তাদের কাছে অনেক কঠিন মনে হয়।
১০. অন্তর্মুখী ও এককেন্দ্রিক হয়ে পড়া:
ডিপ্রেশনে ভোগা ব্যক্তিরা মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে চলতে একসময় অন্তর্মুখী ও এককেন্দ্রিক হয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে। তখন তার সম্পূর্ণটা জুড়ে শুধু সেই থাকে। এর ফলে অন্যের ভালোলাগা -মন্দলাগা অথবা অন্যের কোনো অনুভূতিই তার মধ্যে আর কোনো প্রভাব ফেলে না। সবার প্রতি সে অত্যন্ত উদাসীন হয়ে পড়ে। একসময় সে নিজেও বিষয়টি বুঝতে পারে এবং নিজেকে দোষী মনে করে। কিন্তু সেই গণ্ডি থেকে সে আর বেরোতে পারে না। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, কাছের মানুষ সহ সকল সামাজিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ককে সে অবহেলা করে, কারোর মতামতের প্রাধান্য তার কাছে থাকে না। এ ধরনের মনোভাবের কারণে সকলেই তাকে ধীরে ধীরে এড়িয়ে চলতে শুরু করে এবং একাকীত্বতা তাকে গ্রাস করে। এটি ডিপ্রেশনের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দেয়।
এই লক্ষণগুলো দেখেই আপনি ডিপ্রেশনে ভুগছেন কিনা তা বুঝতে পারবেন। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তি উপরোক্ত লক্ষণগুলোর কারণে ধীরে ধীরে যেন নিজের মধ্যে আরো গুটিয়ে আসে। তার জগতও ধীরে ধীরে আরো ছোট হয়ে আসতে থাকে এবং ডিপ্রেশন তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে থাকে। যা এক ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করে এবং অনেক ক্ষেত্রে এই ডিপ্রেশনের শেষ পরিণতি হচ্ছে আত্মহননের পথ বেছে নেয়া। তাই অন্যকারো অথবা নিজের মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখলে আজই সাবধান হোন এবং সাইকোলজিস্ট দেখিয়ে কাউন্সেলিং শুরু করুন আরো বেশি খারাপ কিছু ঘটার আগেই।
জীবনে আমরা সবাই কোন না কোন সময় দুঃখিত, বেদনার্ত এবং মনঃক্ষুণ্ণ বোধ করি। জীবনের অন্যান্য আবেগের মতই এগুলোও আমাদের জীবনের অংশ। কিন্তু কিছু কিছু অনুভূতি যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়; শারীরিক ক্ষতি হয় কিংবা অনেক সময়ের ব্যবধান ঘটে যায় তখন হিতে বিপরীত হয়ে যায়।
সে সময়েই আমাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত সাহায্যের খুব প্রয়োজন হয়। আপনি নিয়মিত যে চিকিৎসকের কাছে যান, তাকে দিয়েই প্রথম স্তরের চিকিৎসা শুরু করুন।
ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো তিনিই আপনাকে বিশদভাবে বিশ্লেষণ করবেন। প্রথম স্তরেই সুষ্ঠুভাবে চিকিৎসা করাতে না পারলে পরবর্তীতে এটি আরো বৃহদাকার ধারণ করবে। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে যে, দশ জন মানুষের মধ্যে গড়ে একজন ডিপ্রেশনে আক্রান্ত।
চিকিৎসা
‘ডিপ্রেশন টেস্ট’ বলে আদতে কিছু নেই। চিকিৎসক আপনার রোগের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করে এবং শারীরিক পরীক্ষা নিয়ে আপনার রোগ নির্ণয় করবেন।
চিকিৎসক জানতে চাইবেন-
-কবে থেকে উপসর্গগুলো দেখা দিয়েছে
-কতদিন যাবত আছে
-কতোটা মারাত্মক আকারে আছে
-পরিবারে আর কেউ ডিপ্রেশনের শিকার কি না
-আপনি কোনো ধরনের নেশা কিংবা অ্যালকোহলে আসক্ত কি না
ডিপ্রেশনে আক্রান্ত রোগীদের একটি সাধারণ প্রবণতা থাকে আত্মহত্যা করার। আত্মহননমূলক চিন্তা-ভাবনা নিঃসন্দেহে মারাত্মক। সে হিসেবে কিছু হুঁশিয়ারিমূলক ইঙ্গিত উল্লেখ করা হলো
-হঠাৎ করে আনন্দঘন পরিবেশ থেকে হতাশজনক পরিস্থিতিতে চলে যাওয়া।
-সর্বদা মৃত্যুর ব্যাপারে কথা বলা কিংবা চিন্তা করা
-গভীর মনোকষ্ট, যেকোন ব্যাপারে আগ্রহ হারানো, ঘুমে এবং খাদ্যাভ্যাসে ব্যাঘাত ঘটা।
-এমন ঝুঁকিমূলক কাজ করা যেগুলোর পরিণতি মৃত্যু হতে পারে।
-নিজেকে প্রতিটি ক্ষেত্রে অযোগ্য এবং অপদার্থ মনে করা।
-আত্মহত্যার কথা মুখের বুলিতে রূপান্তর করা
আপনার নিজের কিংবা পরিবারের কারোর মধ্যে যদি এমন লক্ষণ দেখে থাকেন, তাহলে যতদ্রুত সম্ভব মনোবিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। মনে রাখবেন, এসব ক্ষেত্রে যত দেরি করবেন তত ক্ষতির হার বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।