ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে সৃষ্ট গণ অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার দেশের প্রধান প্রধান খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এমন অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের এই সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
যাই হোক না কেন’ সরকারকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না জানিয়ে তিনি বলেছেন, আগামী দেড় বছরের মধ্যে দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণ হতে হবে- বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এসব কথা বলেন।
মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তাসংস্থাটি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার পতনের পর ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া প্রধান প্রধান সংস্কার কাজগুলো সম্পন্ন করতে সাহায্য করার জন্য ‘যাই হোক না কেন’ অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান, যাতে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
রয়টার্স বলছে, গত আগস্টের শুরুতে হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এবং সেনাবাহিনী কোনও বাধা দেয়নি। আর এতেই শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায় এবং ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর স্বৈরাচারী এই শাসক পদত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে পালিয়ে যান।
গত সোমবার রাজধানী ঢাকায় নিজের কার্যালয়ে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জেনারেল ওয়াকার বলেন, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।এছাড়া সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তি দেওয়ার একটি রূপরেখাও দিয়েছেন তিনি।
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, আমি তার (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) পাশে থাকব। যাই হোক না কেন। যাতে তিনি তার মিশন সম্পন্ন করতে পারেন।
বিশ্বব্যাপী ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের অগ্রদূত ড. ইউনূস ১৭ কোটি মানুষের দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ প্রশস্ত করতে বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির কয়েক সপ্তাহ আগে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেন, সংস্কারের পর গণতন্ত্রে উত্তরণ এক বছর থেকে দেড় বছরের মধ্যে করা উচিত। তবে এই সময়ে ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে আমি বলব— এই সময়সীমার মধ্যেই আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করা উচিত।
রয়টার্স বলছে, অবশ্য বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং তার সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল উভয়ই গত আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানিয়েছিল।
জেনারেল ওয়াকার বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং তিনি (সেনাপ্রধান) প্রতি সপ্তাহে বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন এবং তাদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। অশান্তির পর দেশকে স্থিতিশীল করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত যে— আমরা যদি একসাথে কাজ করি তবে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনও কারণ নেই।
গত জুলাই মাসে সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তৎকালীন সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়নে ও হিংসাত্মক সংঘর্ষে এক হাজারেরও বেশি লোক নিহত হন। একপর্যায়ে এই আন্দোলন বিস্তৃত সরকারবিরোধী বিদ্রোহে পরিণত হয়, যা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী আন্দোলন।
দীর্ঘ কর্মজীবনে একজন পদাতিক অফিসার হিসেবে এই অশান্তির সময়গুলোতে দায়িত্ব পালন করেছেন জেনারেল ওয়াকার। তিনি বলেছেন, তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাজনৈতিকভাবে কোনও হস্তক্ষেপ করবে না। তিনি বলেছেন, আমি এমন কিছু করব না যা আমার সংস্থার (সেনাবাহিনী) জন্য ক্ষতিকর হয়। আমি একজন পেশাদার সৈনিক। আমি আমার সেনাবাহিনীকে পেশাদার রাখতে চাই।
হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে প্রস্তাবিত ব্যাপক সরকারি সংস্কারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও তার সদস্যদের ইতোপূর্বে করা অন্যায়ের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে এবং ইতোমধ্যে কিছু সৈন্যকে শাস্তিও দিয়েছে। তবে এই বিষয়ে আরও বিশদ কোনও বিবরণ দেননি জেনারেল ওয়াকার।
বাংলাদেশ সেনাপ্রধান বলেছেন, যদি (সেনাবাহিনীর) কোনও কর্মরত সদস্য দোষী সাব্যস্ত হয়, তাহলে অবশ্যই আমি ব্যবস্থা নেব। কিছু সামরিক কর্মকর্তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী (হাসিনা) বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোতে কাজ করার সময় অন্যায় কাজ করতে পারেন।
এদিকে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী জোরপূর্বক “গুম” করা হতে পারে এমন প্রায় ৬০০ জনের রিপোর্ট তদন্তের জন্য হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
যাইহোক দীর্ঘ মেয়াদে জেনারেল ওয়াকার সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে দূরে রাখতে চান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ১ লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি সৈন্য রয়েছে এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অন্যতম প্রধান সেনা প্রেরণকারী হচ্ছে বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, এটি (সেনাবাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা) কেবল তখনই ঘটতে পারে যখন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার কিছুটা ভারসাম্য থাকে, যেখানে সশস্ত্র বাহিনীকে সরাসরি রাষ্ট্রপতির অধীনে রাখা যেতে পারে।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী বর্তমানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে। আর এই মন্ত্রণালয় সাধারণত প্রধানমন্ত্রী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। জেনারেল ওয়াকার বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি সাংবিধানিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় এই বিষয়টিতে সম্ভাব্যভাবে সংশোধনের দিকে নজর দিতে পারে।
বাংলাদেশের এই সেনাপ্রধান বলেন, সামগ্রিকভাবে সামরিক বাহিনীকে কখনোই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা উচিত নয়। একজন সৈনিকের রাজনীতিতে লিপ্ত হওয়া উচিত নয়।