কলকাতার আর জি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক নারী চিকিৎসকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এই ঘটনার বিরুদ্ধে উঠেছে প্রতিবাদের ঝড়।অভিযোগ উঠেছে, তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে হাসপাতালের চিকিৎসকরা ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতির ঘোষণা দিয়েছেন এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
রবিবার ১১ আগস্ট সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় সরকারি হাসপাতালের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে এক নারী চিকিৎসকের। এই ঘটনায় ধর্ষণ ও হত্যার মামলা রুজু করেছে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে।
শুক্রবার সকালে সহযোগী এক চিকিৎসক দেখেন, অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে চিকিৎসকের মরদেহ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথমে এটিকে আত্মহত্যা বলে দাবি করলেও সহকর্মীরা তা প্রত্যাখ্যান করে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ তোলেন। নিহত চিকিৎসক উত্তর চব্বিশ পরগনার সোদপুরের বাসিন্দা ছিলেন।
মৃত চিকিৎসক স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়া ছিলেন। কর্তব্যরত ট্রেনি চিকিৎসকরা প্রতি রাতে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সেমিনার রুমে বিশ্রাম নেন।
বৃহস্পতিবার রাতে ফুড ডেলিভারি সংস্থার কাছ থেকে খাবার আনান চেস্ট মেডিসিন বিভাগের ওই চিকিৎসক। সহযোগী অন্যান্য চিকিৎসকদের সঙ্গে খাবার ভাগ করে খান। সেদিন মধ্যরাতে অলিম্পিকে জ্যাভলিন থ্রোর ফাইনালে নেমেছিলেন ভারতের নীরজ চোপড়া। সেই খেলা চিকিৎসকরা সকলে মিলে দেখেন। প্রায় দেড়টা নাগাদ ইভেন্ট শেষ হয়। দুটো নাগাদ ঘুমোতে যান ৩১ বছর বয়সি ওই নারী চিকিৎসক।
শুক্রবার হাসপাতালেই নিহতের ময়নাতদন্ত হয়।যৌনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। মুখ ও শরীরের অন্যত্র আঘাত ও নখের আঁচড়ের চিহ্ন ছিল। শ্বাসরোধ করে খুনের প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে।
ময়নাতদন্তের সময় ছিলেন স্নাতকোত্তর পড়ুয়ারাও। অন্য হাসপাতালের ফরেন্সিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞদেরও আনা হয়েছিল। ময়নাতদন্তেই অনুমান করা হয়, ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে নারী চিকিৎসককে।
এই ঘটনা দ্রুত রাজ্যব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। শনিবার একের পর এক মিছিলে স্তব্ধ হয়েছে কলকাতার পথঘাট। এসএফআই, ডিএসও মিছিল করেছে। পথে নেমেছেন কলেজের নারী চিকিৎসক, সার্ভিস ডক্টরস ফোরামের সদস্যরা। মূল ফটকের সামনে পুলিশের ব্যারিকেড ও হাসপাতালের শিক্ষার্থীদের অবরোধে মুখে আটকে যায় কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের একটি মিছিল। তুমুল ধস্তাধস্তিতে উত্তেজনা চরমে পৌঁছয়। পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভকারীদের।
এছাড়া বিজেপি নেতা ও স্থানীয় কাউন্সিলররা হাসপাতালে গিয়ে প্রতিবাদ জানান এবং মরদেহ আটকে রাখেন। পরে, রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব এবং পুলিশ কমিশনারের আশ্বাসে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়।
ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে চিকিৎসকের শরীরে আঘাতের চিহ্ন, শ্বাসরোধের আলামত এবং রক্তক্ষরণের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা ধর্ষণ ও হত্যার সন্দেহকে আরও জোরালো করেছে। পুলিশ ইতিমধ্যে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করেছে এবং একটি বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
নারী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে কলকাতা পুলিশের এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতের নাম সঞ্জয় রায়। আরজি কর হাসপাতালে তার অবাধ যাতায়াত ছিল।
হাসপাতালের সেমিনার রুমে কোন সিসিটিভি নেই। তার বাইরের সিসিটিভি ফুটেজ দেখে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারীরা। ফুটেজে চারজনের ছবি দেখা গিয়েছে। এদের মধ্যে একজন সঞ্জয়। বাকি তিনজন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর পরিবারের আত্মীয়। গভীর রাতে তলব পেয়ে তারা চেস্ট মেডিসিন বিভাগে এসেছিলেন।
জিজ্ঞাসাবাদে সঞ্জয়ের বক্তব্যে অসঙ্গতি ছিল। সে সব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেনি। এরপর তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
শনিবার ধৃতকে শিয়ালদহ আদালতে পেশ করা হয়। বিচারক আবেদন অনুযায়ী অভিযুক্তকে ১৪ দিনের জন্য পুলিশ হেফাজতে পাঠিয়েছে।
সূত্রের খবর অনুযায়ী, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, ভোর চারটে নাগাদ সেমিনার রুমে ঢুকছে সঞ্জয়। বেরিয়ে আসছে সাড়ে চারটে নাগাদ। মৃতদেহের পাশে পড়েছিল একটি হেডফোন। সেমিনার রুমে প্রবেশের সময় সঞ্জয়ের গলায় ব্লুটুথ হেডফোন দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বেরোনোর সময় সেটি ছিল না।
দেহের পাশে উদ্ধার হওয়া হেডফোন সঞ্জয়ের, এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সঞ্জয় সিভিক ভলান্টিয়ার হলেও হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে সে যথেষ্ট দাপটের সঙ্গে চলাফেরা করত বলে সূত্রের খবর। রোগী ভর্তির ক্ষেত্রেও তার হাত থাকত।
এবিপি আনন্দকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "ভেতরের কেউ এই ঘটনা ঘটিয়েছে। যাকে ধরা হয়েছে, সে ওখানে যাতায়াত করত। সে যেই হোক, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মামলা নিয়ে গিয়ে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে